‘দিন শেষে আমি ভালোবাসার কথাই মনে রাখি: রক্তযোদ্ধা জাকারিয়া
মোতালেব সরকার
প্রকাশ : ২২ জানুয়ারী ২০২৫, ০৬:৩৭ বিকাল
যখন দেখি রক্ত দেওয়ার মাধ্যমে একজনের জীবন বেঁচে গেছে,তখন অজানা তৃপ্তি পাই। রক্ত দেওয়ার পর রোগীর স্বজনদের হাসিমুখই আমার পরম প্রাপ্তি। তখন নিজেকে খুব ভাগ্যবান মনে হয় যে, আমরা কারও জীবন রক্ষা করতে উসিলা হয়ে সাহায্য করেছি। এই অনুভূতি মো. জাকারিয়া নামের এক স্বেচ্ছাসেবক রক্ত যোদ্ধার। মো. জাকারিয়া ফুলপুর উপজেলার রামভদ্রপুর ইউনিয়নের চর স্বল্পা গ্রামের মোসলেম উদ্দিনের ছেলে এবং স্বেচ্ছায় রক্তদানে আমরা ফুলপুরবাসী'র প্রতিষ্ঠাতা।
রক্তস্বল্পতা, প্রসূতির রক্তক্ষরণ, অগ্নিদগ্ধ রোগী, বড় অপারেশন, দুর্ঘটনা ইত্যাদি নানা কারণে রক্তের প্রয়োজন হয়। এমন সংকটময় মুহূর্তেই টগবগে সুদর্শন তরুণ মো. জাকারিয়ার সংগঠন "স্বেচ্ছায় রক্তদানে আমরা ফুলপুরবাসী' কাণ্ডারি রূপে হাজির হন। রক্তদানের আহ্বানে সাড়া দিয়ে রাত দিন তারা ছুটে বেড়ান মানুষের জীবন বাঁচাতে। রক্ত দিয়ে ফেরেন হাসিমুখে।
কারও রক্তের প্রয়োজন পড়লে জাকারিয়া তা যোগাড় করে দিতে হন্যে হয়ে পড়েন, নিকটাত্মীয়-স্বজন, বন্ধু এমনকি পরিচিতজনদের রক্তের গ্রুপ মোবাইল নম্বরসহ অসংখ্য ব্যক্তির নাম রয়েছে তার কাছে।
মুমূর্ষু রোগীর জীবন বাঁচাতে রক্তের প্রয়োজনে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পোস্ট বা ফোনের মাধ্যমে পরিচিতদের কাছ থেকে তা সংগ্রহ করেন। এই পোস্ট বা ফোনে যোগাযোগের মাধ্যমে কখনো রক্ত পাওয়া যায়, আবার কখনো পাওয়া যায় না। তবুও হাল ছাড়েন না তিনি। মানুষের সেবায় এভাবেই কাজ করছেন তিনি।
রক্ত সংগ্রহের পাশাপাশি মো. জাকারিয়া দেশে থাকা অবস্থায় বেশ কয়েকবার রক্তদান করেছেন। এখন ইরাকের কুর্দিস্তান থেকে দেশের রেমিট্যান্স যোদ্ধা হিসেবেও ভূমিকা রাখার পাশাপাশি সংগঠনটি পরিচালনা করছেন।
তিনি এ সংগঠন থেকে ভ্রাম্যমাণ ক্যাম্পেইনের মাধ্যমে রক্তদাতা সংগ্রহ,ফ্রি ব্লাড গ্রুপ নির্ণয় এবং রক্তদানের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে মানুষকে সচেতন করতে প্রচারণা চালাচ্ছেন।
রক্তদান ছাড়াও শীতবস্ত্র বিতরণ, ব্লাড গ্রুপিং, রক্তদানে উৎসাহিত করা ও থ্যালাসেমিয়া মুক্তির লক্ষ্যে সচেতনতামূলক প্রচারণা, ফুলপুর ব্লাড ব্যাংক চাই রূপকার হিসেবেও আছে সংগঠনটি। বর্তমানে সংগঠনের সদস্যসংখ্যা প্রায় একশো ছাড়িয়েছে।
২০২৪ সালে ফুলপুরের স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যায় নিজস্ব অর্থায়নে ২২৫টি ক্ষতিগ্রস্ত বন্যার্তদের ত্রাণও সহায়তা এবং ৭'শ জনকে একবেলার খাবার এবং সংগঠনটির রেফারেন্সে ১হাজার ৪ শ পরিবারের ত্রান সহায়তা করে এতে সংগঠনটির ৪০ জন স্বেচ্ছাসেবক বন্যার্তদের উদ্ধার এবং ত্রাণ বিতরণে কাজ করে।
শুধু ফুলপুরেই নয় ২০২৪ সালে নোয়াখালী ফেনী ও কুমিল্লায় ভয়াবহ বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত নোয়াখালীতে ৩৫০ টি পরিবারকে ত্রাণ সহায়তা এবং পরবর্তিতে পুর্নবাসনে ১০টি পরিবারকে ৫০ হাজার টাকা অনুদান দেয় সংগঠনটি যা নিয়ে বিভিন্ন গণমাধ্যমেও সংবাদ প্রকাশিত হয়।
স্বেচ্ছায় রক্তদানে আমরা ফুলপুরবাসী'র প্রতিষ্ঠাতা মো. জাকারিয়া বলেন, আমরা স্বপ্ন দেখেছিলাম মানুষের পাশে থেকে সেবা করবো। রক্তের অভাবে একটি প্রাণও যাতে না ঝরে, সেই লক্ষে কাজ করবো।
এই চিন্তাভাবনা থেকে এক ঝাঁক স্বপ্নবাজ তরুণ স্বপ্ন জয়ের নেশায় ২০২১ সালের ১০ই মার্চে প্রতিষ্ঠা করেছিলাম একটি অরাজনৈতিক, অলাভজনক ও শতভাগ সেবামূলক সংগঠন। প্রথমে নাম ছিল স্বেচ্ছায় রক্তদানে আমরা রামভদ্রপুর ইউনিয়নবাসী, পরে উপজেলা পর্যায়ে কার্যক্রম বিস্তৃত হবার পর নামকরণ করা হয় স্বেচ্ছায় রক্তদানে আমরা ফুলপুরবাসী।
আমাদের এই ৪ বছরের পথ চলায় হয় তো খুব বেশি ভূমিকা আমরা রাখতে পারিনি। তবে আমরা সব সময় চেষ্টা করেছি মানুষের কল্যাণে নিজেদের সর্বোচ্চটা দিয়ে পাশে থাকার। আমাদের এই পথ চলাকে সহজ ও মসৃণ করে তুলেছেন রক্তদাতা, স্বেচ্ছাসেবক, শুভাকাঙ্ক্ষী, সবার অক্লান্ত পরিশ্রমের মাধ্যমে আমাদের এই পরিবার অনন্য এক মাত্রায় পৌছাতে সক্ষম হয়েছি।
মানবতার সেবায় শুধু চার বছর বা চার যূগ নয়, যুগের পর যুগ কাজ করে যাব আর্ত-মানবতার সেবায়। আমি তাঁদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি, যারা স্বেচ্ছায় রক্তদান করেছেন, যারা মোটিভেশনের মাধ্যমে অনুপ্রাণিত করে রক্তদাতা তৈরি করেছেন, স্বেচ্ছায় শ্রম-পরামর্শ প্রদান করেছেন ও আর্থিকভাবে সহযোগিতা করে যাচ্ছেন এবং দায়িত্বরত স্বেচ্ছাসেবকরা সুন্দরভাবে, সুষ্ঠু ভাবে দায়িত্ব পালন করেছেন, তাদের সকলের প্রতি কৃতজ্ঞতা। আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য যারা মহৎ কাজে সময় দিচ্ছেন তাদের এই সময় গুলো বৃথা যাবে না।
মো. জাকারিয়া আরও বলেন, সংক্ষিপ্ত আয়ুর জীবনে তেমন কোনো সাফল্য নেই, তবে একটা সাফল্য আছে সেটা হলো স্বেচ্ছায় রক্তদানে আমরা ফুলপুরবাসী' প্রতিষ্ঠা করা। এই সংগঠন থেকে দিন শেষে যদি একজন মানুষও উপকৃত হয় সেটাই বড় সাফল্য বলে মনে করছি। ইতোমধ্যে চার বছরে আমরা ১ হাজার ৮'শ ব্যাগ রক্ত দিতে সক্ষম হয়েছি, আলহামদুলিল্লাহ। ৫০টির মত রক্তের গ্রুপ নির্ণয় ক্যাম্পেইন করতে সক্ষম হয়েছি, এটার ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকবে ইনশাআল্লাহ।
রক্তদান করতে গিয়ে অনেক তিক্ত অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়েছেন মো. জাকারিয়া কিন্তু সেসব ভুলে মানুষের ভালোবাসার কথাই তিনি মনে রাখেন। তিনি বলেন, এখনো অনেক রোগীর স্বজন খোঁজ নেন, পারিবারিক কোনো আয়োজনে আমন্ত্রণ জানান। ‘দিন শেষে আমি ভালোবাসার কথাই মনে রাখি।’