আওয়ামীলীগ শাসনের পতন আর নতুন সরকারের কাছে ছাত্র-জনতার প্রত্যাশা
ছাত্র-জনতার এক অভাবনীয় আন্দোলনের মধ্য দিয়ে আওয়ামীলীগ শাসনামলের পতন ঘটে ৫ আগষ্ট। যার অগ্রভাগে থেকে নেতৃত্ব দেয় দেশের ছাত্র সমাজ। গোটা বিশ্বকে অবাক করে একটি অরাজনৈতিক ইস্যুকে কেন্দ্র করে মহা পরাক্রমশালী রাষ্ট্র যন্ত্রের একচ্ছত্র আধিপত্য আর সকল প্রতিরোধের প্রাচীর তাসের ঘরের মত ভেঙে পরে হুরমুর করে। আবারও প্রমাণিত হলো সম্মিলিত ছাত্র-জনতার জাগ্রত বিবেক মহা প্রলয় ঘটিয়ে দিতে পারে। এবারের ছাত্র আন্দোলনে কেবলমাত্র আওয়ামীলীগ শাসক গোষ্ঠীর জন্য যে দুর্যোগের পরিনতি ডেকে এনেছে তা নয়, অনাগত দিনগুলোতে যারাই বাঙালিকে জুলম-নির্যাতনে নিষ্পেষিত করে শোষণ করতে চাইবে তাদের জন্য এটা এক আগাম হুশিয়ারি বার্তা। তবে আমরা এতটাই দুর্ভাগা জাতি, ইতিহাসের এ সব শিক্ষা ক্ষমতার মসনদে আরোহনের পর সবাই বেমালুম ভুলে যাই। এদেশে আন্দোলন-সংগ্রামে সরকার পতনের বেশ ক'টি নজির রয়েছে। কিন্তু এবারের পরিণতি একেবারেই অকল্পনীয়।
মৌলিক চেতনাকে ধারণ করে যে দলের জন্ম, দীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রামের মধ্য দিয়ে দাবি আদায়ের ঐতিহ্য হতে পারতো যে দলের অহংকার, কেন জানি তাদের সাধ হলো স্বৈরশাসকে আবির্ভূত হবার! গৌরবময় মহান স্বাধীনতা সংগ্রামের নেতৃত্ব দানকারী দলটি হতে পারতো বাঙালি জাতির নির্ভরতার প্রতীক, অথচ দাম্ভিকতা আর অহংবোধে সকলের অনাস্থায় রচিত হলো এক মর্মান্তিক অধ্যায়। এতটা অবহেলা, অবজ্ঞা আর অযাচিত আচরণে প্রজাতন্ত্রের মালিকদের দাবায়ে রাখা যায় না তা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে সু-স্পষ্টভাবে।
দুর্নীতি, দলীয়করণ, স্বজনপ্রীতি, নিপীড়ন, জুলুম, নির্যাতন এ সবের ওপর ভর করে একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র পরিচালনা কারোরই কাম্য হতে পারেনা। বারংবার ব্যার্থতার পরও শাসক গোষ্ঠীর এ সবের প্রতিই ছিলো নির্ভরতা। গণমানুষ থেকে উঠে আসা একটি রাজনৈতিক দলের কাছ থেকে এমন আচরণ কেউ কখনো প্রত্যাশা করেনি। সঙ্গত কারণেই যার চরম মূল্য দিতে হলো নির্মমভাবে।
জাতি অবাক হয়ে দেখল কোমলমতি শিক্ষার্থীদের সফল এক দুর্বার আন্দোলন, যার পরিণতি পেল গণঅভ্যুত্থানের; রচিত হলো অনন্য এক ইতিহাস। এমন একটি অভাবনীয় বিজয়ের পর জনতার বাঁধভাঙা উচ্ছ্বাস খুবই স্বাভাবিক। কিন্তু পরবর্তীতে জাতির আবেগ ও মর্যাদার বাহক বেশ কিছু ভবনে ভাংচুর ও অগ্নি সংযোগ, পুলিশের ওপর হামলা, ডাকাতি ও লুটপাট আদৌ কারোর কাছেই কাঙ্খিত ছিলোনা। বহিঃর্বিশ্বে তান্ডবের এমন দৃশ্য আমাদের ইমেজ নিঃসন্দেহে দুর্বল করে। তবে এ সবে ছাত্র সমাজের আদৌ কোন সমর্থন ছিল না। বিচক্ষণ ছাত্র নেতৃত্বের শক্ত হস্তক্ষেপে দ্রুত সময়েই তা নিয়ন্ত্রণে চলে আসে। রাষ্ট্র ও প্রশাসন পরিচালনায় যাদের আদৌ কোন অভিজ্ঞতা নেই নতুন সরকার গঠন প্রক্রিয়ায় তাদের গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন, রাস্তার ট্রাফিক ব্যবস্থা সচল রাখা, বাজারের দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে মনিটরিং, পরিচ্ছন্নতার কাজ, অপরাধ দমনে পাড়ায়-মহল্লায় রাত জেগে পাহাড়া দেয়া ও নৈরাজ্য দূরিকরণের সোচ্চার অবস্থান সমগ্র জাতিকে অবাক করেছে। সর্ব মহল থেকে ধ্বনিত হচ্ছে সাবাশ বাংলাদেশ, সাবাশ!
ছাত্র সমাজের স্পষ্ট উচ্চারণ; বৈষম্য দূরিকরণে যৌক্তিক সংস্কার। স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া শিক্ষার্থীরা এবার যৌক্তিক দাবি আদায়ে ছিল দুর্বার, অপ্রতিরোধ্য। ৫৩ বছর পূর্বে স্বাধীনতা অর্জনের পর অনেক দেরিতে হলেও আঠারো কোটি বাঙালিকে তারা রাষ্ট্র বিনির্মানে দেখাল সু-স্পষ্ট দিক নির্দেশনা। রাষ্ট্র যন্ত্রের মৌলিক কাঠামোগুলোর সংস্কার ও চর্চার মধ্য দিয়েই কেবলমাত্র তা টেকসই হতে পারে। যারাই পরবর্তীতে রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বভার গ্রহণ করবেন তাদেরকে অবশ্যই দিতে হবে সুশাসন, সুশাসন এবং সুশাসন। অন্যথা ভোগ করতে হবে চরম ঘৃণা, অপমান আর বঞ্চনা।
শত শহীদের রক্তে রাজপথ রঞ্জিত হয়ে আঠারো কোটি বাঙালির আজ প্রত্যাশা, ন্যায় ভিত্তিক সমাজ গঠনের মধ্য দিয়ে নির্মিত হোক সুখি ও সমৃদ্ধ নতুন এক বাংলাদেশ। সকল রাজনৈতিক দলের সমর্থন, রাষ্ট্র কাঠামোর অংশিজনদের প্রতিশ্রুতি আর নতুন প্রজন্মের মেধাবী ছাত্র সমাজের দৃঢ প্রত্যয়ের ওপর ভর করে ছাত্র প্রতিনিধি ও অভিজ্ঞজন মিলে দেশে এই প্রথম নবীন-প্রবীণের নতুন ধারার একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারে যারা আজ নতুন করে রাষ্ট্র বিনির্মানের শপথ নিলেন তাদের হাত ধরেই আগামী দিনের তেজদীপ্ত সূর্য পূর্ব দিগন্তে আলো ছড়াবে তার জন্যই সকলের অধীর অপেক্ষা।
সৈয়দ আরিফুজ্জামান
সম্পাদক
আজকের আরবান।
সৈয়দ আরিফুজ্জামান
.