মঙ্গলবার, ১১ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ২৭ মাঘ ১৪৩১
শিরোনাম

অন্তর্বর্তী সরকারের রাষ্ট্র সংস্কারের উদ্যোগ ও জন-আকাঙ্ক্ষা

বহুমাত্রিক পুঞ্জিভূত ক্ষোভ থেকে জুলাই-আগস্ট মাসে অনিবার্য এক গণআন্দোলনের ফলশ্রুতিতে আওয়ামীলীগ শাসনামলের পতন ঘটে। এবারে আন্দোলন খুব অল্প সময়ের মধ্যে ব্যাপকভাবে দানা বাঁধে মূলত ছাত্র-জনতার স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণের ফলশ্রুতিতে। রাষ্ট্র পরিচালনায় স্বেচ্ছাচারিতা, রাজনৈতিক বিবেচনায় দমন-পীড়ন, বাক স্বাধীনতা রোধ, প্রশাসনকে দলীয়করণ, শাসনতন্ত্র পছন্দ মাফিক পরিবর্তন, রাষ্ট্রিয় সম্পদ লুট ও বিদেশে পাচার, নির্বাচন ব্যবস্থাকে কলুষিত করাসহ নানান কারণে আওয়ামীলীগ জনগণের আস্থা হারায়। বহু বছরের বঞ্চনার ফলে তাই নতুন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি ছাত্র-জনতা তথা আপামর জনগণের ব্যাপক প্রত্যাশা; রাষ্ট্র বিনির্মাণে যৌক্তিক ও প্রয়োজনীয় সংস্কার।

ড. মোহাম্মদ ইউনুস এর নেতৃত্বে ৮ আগষ্ট যে সরকার গঠিত হয় তাদের অগ্রাধিকারভিত্তিক কাজের মধ্যে সংস্কারের বিষয়টিও প্রাধান্য পায় নিঃসন্দেহে। যার প্রেক্ষিতে ইতোমধ্যে দশটি সংস্কার কমিশনও গঠিত হয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন হল সংস্কার কার জন্য? জনগণের আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নের জন্য সংস্কার হলে রাষ্ট্র কাঠামোর অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অংশ রাজনৈতিক দলসমূহের সমর্থন ও সস্পৃক্ততা কতটুকু সংস্কার প্রক্রিয়ায় রয়েছে তা ভাববার বিষয়। বৃহৎ পরিসরে রাজনৈতিক সমঝোতা ছাড়া কেবল আইনের সংস্কার করলেই তা জনকল্যাণে কাজে আসবে না। রাষ্ট্র পরিচালনায় প্রণীত আইন-কানুনের প্রতি রাজনৈতিক দল সমূহের সমর্থন ও আস্থা খুবই জরুরী। 

সংস্কারের জন্য গঠিত কমিটিসমূহ প্রধান প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে আলোচনা না করে গঠিত হবার ফলে এসব কমিটি নিয়ে দলগুলোর আস্থা ও আগ্রহ খুবই কম। দীর্ঘ দেড় দশক দেশে সুষ্ঠু রাজনৈতিক পরিবেশ না থাকায় রাজনৈতিক দলসমূহের মধ্যে নির্বাচন কেন্দ্রীক অস্থিরতা থাকাটা বেশ স্বাভাবিক। মূলত রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণাকে বেশি প্রাধান্য দিচ্ছে, এটাই বাস্তবতা। সেই বিবেচনায় সংস্কার প্রক্রিয়া গুরুত্ব হারাতে পারে।

সাধারণত কেয়ারটেকার সরকারকে এদেশের মানুষ তিন মাস সময় দিতে অভ্যস্ত। কিন্তু এবারের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার কত দিনের জন্য রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বে থাকবে তা নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐক্যমত্য না হলে গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার প্রক্রিয়াও খুব বেশি আমলে আসবেনা। 

বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার আড়াই মাস ধরে রাষ্ট্র পরিচালনা করছে, ভাবতে হবে সাধারণ মানুষের জীবনমানের ক্ষেত্রে বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার কতটুকু অবদান রাখতে পারছে। দ্রব্যমূল্যের ঊর্দ্ধগতি, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি, প্রশাসনে শৃঙ্খলা, রাষ্ট্রপতিকে অপসারন, ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ করা, দিবস হিসেবে ৭ মার্চ বাতিল, অভ্যুত্থান না বিপ্লব, সাংবিধানিক না বিপ্পবী সরকার, দ্বিতীয় স্বাধীনতা, রিসেট বাটন, আন্দোলনের মাস্টার মাইন্ড, সমন্বয়কদের নতুন রাজনৈতিক দল গঠন, পূর্ববর্তী সরকারের ন্যায় গায়েবী মামলা, সংবিধান সংশোধন না পুনঃলিখন, নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষনা, অন্তর্বর্তী সরকারের মেয়াদ, সরকার এনজিও প্রতিনিধির আধিক্য, আওয়ামীলীগকে রাজনীতি ও নির্বাচন থেকে দূরে রাখাসহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে এখনো রাজনৈতিক অঙ্গনে ঐক্যমত্য সৃষ্টি না হওয়ায় এর মধ্যেই রাষ্ট্র বিনির্মাণে প্রয়োজনীয় সংস্কার ও এর সাফল্য নিয়ে রাজনৈতিক বিশ্লেষকগণ সন্দিহান হতে শুরু করেছেন। আন্দোলনে রাজনৈতিক দল, সোশ্যাল মিডিয়ার এক্টিভিস্টসহ বিভিন্ন পর্যায় থেকে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি অনেকেই অনাস্থা প্রকাশ করতে শুরু করেছে ইতোমধ্যে। কাল বিলম্ব না করে অতি দ্রুত সংস্কার বাস্তবায়নের পরিবেশ দৃশ্যমান হতে হবে।

মহান মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতা লাভের পরবর্তীতে সময়ে সময়ে অনেক বার যৌক্তিক জন-আকাঙ্ক্ষা নিয়ে ছাত্র-জনতা ঐক্যবদ্ধ হয়েছে, সফল আন্দোলন সংগ্রামে সরকার পতন ও পরিবর্তনও হয়েছে। কিন্তু বাস্তবিক পক্ষে রাষ্ট্র বিনির্মাণে গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার কখনোই আলোর মুখ দেখেনি। শিশু-কিশোর, যুবক, বৃদ্ধ, নারী-পুরুষসহ ঐক্যবদ্ধ ছাত্র-জনতার সম্মিলিত আন্দোলন থেকে জাতির যে আকাঙ্ক্ষা, বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার তা পূরণ করতে ব্যার্থ হলে অনাগত দিনগুলোতে আমাদের জন্য কেবলই অপেক্ষা করছে অমানিশার অন্ধকার।


  সৈয়দ আরিফুজ্জামান

সম্পাদক
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত