শনিবার, ১২ জুলাই ২০২৫, ২৮ আষাঢ় ১৪৩২
শিরোনাম

হাওড়ের প্রাণভোমরা নৌকার বাজারে এবার মন্দার ছায়া, ক্ষতির মুখে পাঁচ শতাধিক পরিবার


  শহীদুল ইসলাম রেদুয়ান, শান্তিগঞ্জ প্রতিনিধি

প্রকাশ :  ১২ জুলাই ২০২৫, ০৪:১৩ দুপুর

হাওড়ের মানুষ যুগ যুগ ধরে বলে আসছে - বর্ষায় নাও, শুকনায় পাও। কিন্তু সেই প্রবাদ যেন এখন শুধু কথার কথা।
 
সুনামগঞ্জের শান্তিগঞ্জ উপজেলার ঐতিহ্যবাহী আক্তাপাড়া নৌকা হাটে এবার বর্ষা মৌসুমেও পানির দেখা নেই। ফলে তিন যুগের পুরোনো এই নৌকা হাটে দেখা দিয়েছে বড় ধরনের ব্যবসায়িক ধস। ক্রেতাহীন বাজারে দিনভর দাঁড়িয়ে থেকেও হতাশ হয়ে বাড়ি ফিরছেন শত শত নৌকা ব্যবসায়ী।
 
প্রতি শুক্রবার আক্তাপাড়ার মাঠজুড়ে বসে দেশের অন্যতম বৃহৎ নৌকা হাট। হাওর অঞ্চলের জীবিকা, যাতায়াত এবং কৃষিকাজে ব্যবহৃত নানা রকমের নৌকা - বজরা, বারকী, হিল্লা,পাতামী ইত্যাদির কেনাবেচা হয় এই হাটে। কিন্তু এবার চিত্র একেবারে ভিন্ন। মাঠজুড়ে সাজানো আছে তিন-চার শতাধিক নৌকা, অথচ আগ্রহী ক্রেতার দেখা নেই।
 
নৌকা হাটে গিয়ে দেখা যায়, বিক্রেতারা সারাদিন দাঁড়িয়ে থাকলেও বেচাবিক্রির তেমন কোনো গতি নেই। অনেকেই মুখে হতাশার ছাপ নিয়ে বলছেন, পানি নেই, মানুষ কেন নৌকা কিনবে? নৌকা তৈরির উপকরণ, বিশেষ করে কাঠের দাম বেড়ে গেছে প্রায় ৩০ শতাংশ। আগে যেই নৌকা বানাতে লাগত ৯ হাজার টাকা, এখন সেখানে খরচ পড়ছে ১৫ হাজার টাকার কাছাকাছি। কিন্তু এই বাড়তি খরচ আর বিক্রির অনিশ্চয়তা নিয়ে দিশেহারা ব্যবসায়ীরা।
 
বর্তমানে একেকটি বারকী বিক্রি হচ্ছে ২০-২২ হাজার টাকায়, পাতামী ১৩-১৫ হাজার, আর হিল্লা ৫-৭ হাজার টাকায়। দাম বাড়লেও ক্রেতা নেই। স্থানীয় ব্যবসায়ী কাদির মিয়া বলেন,নৌকা বানাইছি ৭০টা, বিক্রি হইছে ৪০টা। প্রতিদিন হাটে বসি, কিন্তু খালি হাতে ফিরি। একবার ভাবি ঋণের টাকা দিমু কই থেইকা ? 
 
হাট কর্তৃপক্ষের দেওয়া তথ্য মতে, গত বছর প্রতি মৌসুমে গড়ে ১২০০টি নৌকা বিক্রি হতো এ বাজারে। এবার সেই সংখ্যা নেমে এসেছে মাত্র ৪০০-এ। সপ্তাহে যে হাটে আগে ২০০টি নৌকা বিক্রি হতো, সেখানে এখন তা হচ্ছে ৫০-৬০টি। এর প্রভাব পড়েছে নৌকার সাথে জড়িত অন্যান্য পণ্যের ওপরও। 
 
এই হাট ঘিরে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে প্রায় ৫০০ জন মানুষের জীবিকা জড়িয়ে আছে—নৌকা নির্মাণকারী কারিগর, কাঠ ব্যবসায়ী, বৈঠা প্রস্তুতকারক, পরিবহন শ্রমিক, ইজারাদারসহ আরও অনেকে। অনেকেই এনজিও বা ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে বিনিয়োগ করেছেন, কিন্তু এখন বিক্রি না হওয়ায় পড়েছেন চরম আর্থিক সংকটে।
 
হবিগঞ্জ থেকে আসা বৈঠা ব্যবসায়ী বাছির মিয়া বলেন, আগে একেক হাটে ১০০০টা বৈঠা বিক্রি করতাম। এখন ২০০টা কষ্ট করে যায়। দাম বাড়াইছি, তারপরও বিক্রি হয় না।
 
শান্তিগঞ্জ উপজেলার রনসী গ্রামের জুয়েল মিয়া বলেন,ব্যাংক থেকে লোন নিয়া নৌকা বানাইছি। এখন বেচা হয় না। টাকা উঠতেছে না, সুদ বাড়তেছে, ঘুম হারাম হইয়া গেছে। ক্রেতারাও হতাশ। হাওরে পানি না থাকায় নৌকা কেনার প্রয়োজনও কমে গেছে। ছাতক উপজেলার বড়কাপন গ্রামের আজমান আলী বলেন,আগে মাছ ধরা, ঘাস আনা, ধান নেওয়ার জন্য নৌকা লাগত। এখন তো খালে বিলেই পানি নাই। কিনে কী করম?
 
বাজারের ইজারাদার মুরাদ চৌধুরী ও সামছুদ্দিন সুনু বলেন, টানা পাঁচটা হাট ভালো গেলে আমরা লাভে থাকি। কিন্তু এবছর এক সপ্তাহ বাদে সব হাটেই ফাঁকা। এখন শুধু বৃষ্টির আশায় বসে আছি। তারা আরও জানান, বাজারে যাতে নিরাপত্তা ও ব্যবস্থাপনা উন্নত হয়, সে জন্য স্থানীয় প্রশাসনের সহযোগিতা চাওয়া হয়েছে।
 
শান্তিগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সুকান্ত সাহা বলেন,আক্তাপাড়া নৌকা হাট আমাদের অঞ্চলের একটি ঐতিহ্যবাহী বাজার। এখানে যাতে আরও ভালোভাবে বেচাকেনা হয়, সেজন্য সোলার লাইট স্থাপন, সিসি ক্যামেরা ও উন্নত ব্যবস্থাপনার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে।
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত