নেত্রকোনা বন্যায় সব হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে কৃষকের চোখে মুখে শুধুই দুঃস্বপ্ন
মো: আরিফুল ইসলাম
প্রকাশ : ১০ অক্টোবর ২০২৪, ০৪:০০ দুপুর
হঠাৎ করে অসময়ে বানের জলে ভাসিয়ে নিয়ে গেল কৃষকের ফসল আর পুকুর ভরা মাছ। সব হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে কৃষকের চোখে মুখে শুধুই দূ-স্বপ্ন।
নেত্রকোনায় গত কয়েক দিনের টানা বর্ষণ আর পাহাড়ি ঢলে গত পাঁচদিন ধরে নেত্রকোনার চার উপজেলার দেড়লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছিল।
কংস নদীর পানি কমতে শুরু করলেও নিষ্কাশন সুবিধা না থাকায় ধীরগতিতে নামছে পানি। যে কারণে নষ্ট হয়ে গেছে ২২ হাজার হেক্টর আমন ক্ষেত।
বন্যা কবলিত এলাকায় ঘুরে দেখা গেছে, মাঠের পর মাঠ বন্যার পানিতে তলিয়ে গেছে ফসলি জমি।
তবে অনেক এলাকায় কিছুটা উন্নতি লক্ষ্য করা গেছে। অন্যদিকে কংস নদীর পানি কমলেও বাড়িঘরে থাকা পানি সরতে আরও দেড়-দুই সপ্তাহ সময় লাগতে পারে। পাশাপাশি গত কয়েক দফায় বন্যার কারণে আমন আবাদ করে অবশেষে আবারও তলিয়ে নষ্ট হয়েছে কৃষি জমি। প্রান্তিক পর্যায়ের অনেক কৃষকের ধানের ওপর নির্ভরশীল থাকলেও এবার একেবারেই সব হারিয়েছে তাদের।
বাট্টাপাড়া গ্রামের হাদিস মিয়া নামের এক কৃষক জানান, তারা ৫ ভাই মিলে প্রায় ২০০ কাঠা জমিতে ধানের আবাদ করেছিলেন। এতে খরচ হয়েছে দেড়লক্ষাধিক টাকা। এবার সব তলিয়ে একেবারে নিঃস্ব হয়ে পরেছেন।
একই এলাকার সোনা মিয়া বলেন, ‘তারা সব ভাইয়েরা মিলে কৃষিকাজ করেই চলেন। এটাই তাদের একমাত্র পেশা। বাড়িঘরেও ঢুকতে পারছেন না তারা। ছোট ছেলে-মেয়েরা ঘর থেকে বের হতে পারছে না।
কৃষি বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, জেলায় এ বছর রোপা আমনের আবাদ হয়েছিলো এক লাখ ৩৫ হাজার ৯০০ হেক্টর। তারমধ্যে বন্যায় গেল ৫ দিনে ২২ হাজার ৬৪১ হেক্টর ধান ও এক হাজার ৬৪৫ হেক্টর সবজি নষ্ট হয়েছে। ৫ লক্ষাধিক কৃষকের মধ্যে ৬৯ হাজার ৪৫০ কৃষক পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। এতে প্রায় ২৯৩ কোটি টাকা মূল্যের ধান নষ্ট হয়েছে।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপ-পরিচালক কৃষিবিদ মোহাম্মদ নরুজ্জামান বলেন,এখন আমন আবাদের সময় শেষ। যে কারণে আবার আবাদ করার সুযোগ নেই। ইরি বোরো মৌসুম চলে আসায় হয়তো পরবর্তী প্রস্তুতি নিতে হবে। তবে ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা তৈরি করে তাদের ক্ষতি পোষাতে প্রণোদনা দেয়া হতে পারে বলে জানান তিনি।
৮ কোটি ২৪ লাখ টাকার মৎস্যসম্পদের ক্ষতি হয়েছে।
আকষ্কিক বন্যায় ভেসে গেছে নেত্রকোনার পাঁচ উপজেলার কয়েক হাজার পুকুরের মাছ।
নেত্রকোনার কলমাকান্দা উপজেলার আমতৈল গ্রামের চাষি সাইফুল ইসলাম। একই উপজেলার চানদুয়াইল গ্রামের যশু মিয়া তিনটি পুকুরে বিনিয়োগ করেন প্রায় ১৬ লাখ টাকা। এগুলো নিয়ে তাঁদের অনেক স্বপ্ন আর প্রত্যাশা ছিল। কিন্তু বন্যার পানিতে পুকুরগুলোর প্রায় সব মাছ ভেসে গেছে।
শুধু এই দুইজনেই নন, তাঁদের মতো অন্য উপজেলা দুর্গাপুর, পূর্বধলা, বারহাট্টা ও সদর সহ এক থেকে দেড় হাজার মাছচাষির স্বপ্ন এবার ভেসে গেছে বন্যার পানিতে।
জেলার মৎস্য কর্মকর্তার কার্যালয়ের তথ্য মতে, সর্বশেষ বন্যায় নেত্রকোনার পাঁচ উপজেলায় প্রায় ৮ কোটি ২৪ লাখ ৬৫ হাজার ৩২০ টাকার মৎস্যসম্পদের ক্ষতি হয়েছে। তবে এ ক্ষতির পরিমাণ আরও বেশি বলে দাবি করেছেন স্থানীয়রা।
স্থানীয়দের ও নেত্রকোনা মৎস্য কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে,এই জেলাতয় মুক্ত ও বদ্ধ জলাশয়ের পরিমাণ ৮৪ হাজার ১৬৫ হেক্টর, এতে মাছ উৎপাদন হয় প্রায় ১ লাখ ১০ টন। এর মধ্যে ছোট–বড় ৮৯টি হাওরে ৪০ শতাংশ, খাল-বিল ও নদ-নদীতে ১৫ শতাংশ মাছ উৎপাদিত হয়। বাকি ৪৫ শতাংশ মাছ পুকুরে চাষ করা হয়। জেলায় মোট পুকুরের সংখ্যা ৬০ হাজার ১০২। আর মাছচাষির সংখ্যা ৪৮ হাজার ২৩৮ জন।
এই জেলার মোট উৎপাদিত মাছের অর্ধেকই উদ্বৃত্ত থাকে, যা দেশের বিভিন্ন স্থানে সরবরাহ করা হয়ে থাকে। কিন্তু ভারী বৃষ্টি ও উজান থেকে নেমে আসা ঢলের কারণে নেত্রকোনার ছোট-বড় সব নদ-নদীর পানি বেড়ে বন্যা দেখা দেয়।
সূত্রগুলো আরও তথ্য মতে, বন্যাদুর্গত এলাকায় মৎস্যসম্পদের ৩১২ দশমিক ৫৯ হেক্টর জমিতে অন্তত ১ হাজার ৪৮০টি পুকুর এবং খামারের ৭২৩ দশমিক ৪৩ মেট্রিক টন মাছ ও পোনা ভেসে গেছে। এ কারণে ৮৯৬ জন মাছচাষির প্রত্যক্ষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। সরকারি হিসেবে শুধু মাছেই তাঁদের ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৮ কোটি ২৪ লাখ ৬৫ হাজার ৩২০ টাকা। তবে চাষিদের দাবি, মৎস্যসম্পদের মোট ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ১০ কোটি টাকার বেশি।
এই বন্যার কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে দুর্গাপুর, কলমাকান্দা ও সদর উপজেলায়। সদরের ৯৬৩টি ও কলমাকান্দায় ৩২২টি পুকুরের মাছ ভেসে গেছে। এতে পুঁজি হারিয়ে পথে বসেছেন এসব মৎস্যচাষি।
নেত্রকোনার মৎস্য কর্মকর্তা শাহজাহান কবির বলেন, এ ক্ষতি পুষিয়ে নিতে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে বরাদ্দ চাওয়া হবে।
জেলা প্রশাসক বনানী বিশ্বাস বলেন, বন্যায় শুধু পুকুরের মাছ ভেসে যাওয়া নয়, রাস্তাঘাট থেকে শুরু করে ঘরবাড়ি, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ বেশ কিছু সম্পদের ক্ষতি হয়েছে। অসংখ্য মানুষ পানিবন্দী আছেন। ত্রাণসহায়তাসহ প্রশাসনের পক্ষ থেকে সার্বিক পরিস্থিতি মোকাবিলা করা হচ্ছে। আশা করা যাচ্ছে, সকলের সম্মিলিত সহযোগিতায় এ সংকট সহজে কেটে যাবে।
তবে স্থানীয়দের মতে যে পরিমাণ ত্রাণ সামগ্রী বিতরণ করা হচ্ছে তা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। কিছু কিছু জায়গায় ত্রাণ একাধিক বার দেয়া হয়েছে আবার কিছু জায়গায় ত্রাণ সামগ্রী তেমন পৌঁছায়নি।