মঙ্গলবার, ২৮ অক্টোবর ২০২৫, ১২ কার্তিক ১৪৩২
শিরোনাম

কুঁসিকাটা থেকে বিশ্ববাজারে—আফরোজা আক্তার লিজার অনুপ্রেরণার গল্প


  আজাদ ইমরান শরীফ

প্রকাশ :  ২৭ অক্টোবর ২০২৫, ১২:২৯ দুপুর

নেত্রকোণা সদর উপজেলার প্রত্যন্ত পঁচাশিপাড়া গ্রামের এক রক্ষণশীল পরিবারে জন্ম আফরোজা আক্তার লিজার। ছোটবেলা থেকেই স্বপ্ন ছিল নিজের কিছু করার, কিন্তু পারিবারিক অনীহায় ২০০৩ সালে এসএসসি পাসের পর পড়াশোনা থেমে যায়। ২০০৭ সালে বিয়ের পরও ভেবেছিলেন, নতুন জীবনে হয়তো শান্তি আসবে। কিন্তু তা হয়নি। স্বামীর অবহেলা, নির্যাতন আর মানসিক যন্ত্রণায় টানা আট বছর সংসার টেকানো সম্ভব হয়নি তাঁর পক্ষে। সন্তানকে নিয়ে ফিরে আসেন বাবার বাড়িতে—এভাবেই শুরু হয় লিজার নতুন পথচলা।

শৈশব থেকেই সুই-সুতার কাজে দক্ষ ছিলেন লিজা। জীবনের কঠিন বাস্তবতায় সেই দক্ষতাকেই হাতিয়ার বানান। যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর, বিসিকসহ সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে প্রশিক্ষণ নেন বাটিক, সেলাই, বিউটিফিকেশনসহ নানা বিষয়ে। উদ্যোক্তা হিসেবে নিবন্ধিত হন বিসিকে।

মাত্র ৫ হাজার টাকা মূলধন নিয়ে কুঁসিকাটার ছোট কাজ দিয়ে শুরু হয় তাঁর উদ্যোক্তা জীবন। শিশুদের জামা থেকে শুরু করে বিভিন্ন ডিজাইন পণ্য তৈরি করে দোকানে সরবরাহ করতে থাকেন। ধীরে ধীরে চাহিদা বাড়ে, আয়ও বাড়ে। এই আয় দিয়েই লিজা স্বপ্ন দেখেন আত্মনির্ভরতার, আর সেই স্বপ্নেই জড়িয়ে পড়েন এলাকার অসচ্ছল নারীরাও।

বর্তমানে লিজা বুটিকস হাউজে পণ্য তৈরির কাজে যুক্ত আছেন ৫০ জনেরও বেশি নারী। তারা বাড়িতে বসেই পণ্য তৈরি করেন এবং মাসে ৫ থেকে ৬০ হাজার টাকা পর্যন্ত আয় করেন। ২০২৩ সালে শহরের নাগড়া শিববাড়ি এলাকায় প্রতিষ্ঠা করেন তাঁর সেলস সেন্টার—“লিজা বুটিকস হাউজ”। এখান থেকেই তাঁর তৈরি কুঁসিকাটার পণ্য এখন শুধু দেশেই নয়, পাড়ি দিচ্ছে আমেরিকা, কানাডাসহ বিদেশি বাজারেও।

কামরুন্নাহার বাবলী নামে এক কর্মী বলেন, “লিজা আপার হাত ধরেই আমার জীবন বদলে গেছে। আগে সংসারে অভাব ছিল, এখন নিয়মিত আয় করি, ছেলেমেয়েদের পড়াশোনা চালাতে পারি।”

আরেকজন নারী কর্মী মিনা বেগম জানান, “লিজা আপা আমাদের শুধু কাজ দেননি, দিয়েছেন নতুন জীবনের আশা। এখন সংসার চালাতে কষ্ট হয় না।”

লিজা শুধু অর্থনৈতিকভাবে নয়, সামাজিকভাবেও সক্রিয়। কর্মরত নারীদের স্বাস্থ্য সচেতনতা, সন্তানদের শিক্ষা, বাল্যবিবাহ প্রতিরোধ ও প্রতিবন্ধী শিশুদের কল্যাণে কাজ করে যাচ্ছেন নিয়মিত।

জেলা যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক ফারজানা পারভীন বলেন, “লিজা প্রমাণ করেছেন ইচ্ছা আর পরিশ্রম থাকলে নারীও উদ্যোক্তা হতে পারেন। তিনি শুধু নিজেই আত্মনির্ভর নন, আরও অর্ধশত নারীকে স্বাবলম্বী করেছেন।”

নিজের স্বপ্নের কথা বলতে গিয়ে আফরোজা আক্তার লিজা বলেন, “আমি চাই শহরের কেন্দ্রস্থলে বড় একটি শোরুম আর একটি কারখানা করতে। আমার কুঁসিকাটা পণ্যের একটা ব্র্যান্ড গড়তে চাই। এজন্য সরকারের সহযোগিতা আর স্বল্পসুদে ঋণ প্রয়োজন।”

শেষে তিনি নারীদের উদ্দেশে বলেন, “নারীরা যদি ঘরে বসে না থেকে কিছু না কিছু কাজ শুরু করেন, তাহলে নিজেরা যেমন বদলাবেন, দেশও এগিয়ে যাবে।”

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত