বৃহস্পতিবার, ৩১ জুলাই ২০২৫, ১৬ শ্রাবণ ১৪৩২
শিরোনাম

ময়মনসিংহে ৭ জেলার বিচারকদের মতবিনিময়


  দেলোয়ার হোসেন

প্রকাশ :  ২৭ জুলাই ২০২৫, ১১:৩৩ দুপুর

বাংলাদেশ জুডিসিয়াল সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের (বিজেএসএ) পক্ষ থেকে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা, বিচারকদের পদোন্নতি ও নিয়োগবৈষম্য, বাজেট সংকট এবং রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়।
 
নির্বাহী বিভাগ থেকে বিচার বিভাগকে সম্পূর্ণরূপে পৃথক করতে হবে। তাছাড়া একটি স্বাধীন বিচার বিভাগীয় সচিবালয় প্রতিষ্ঠা করতে হবে এবং সুপ্রিম কোর্টের অধীনে বিচারকদের নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা ন্যস্ত করতে হবে। 
 
গতকাল শনিবার সকালে নগরীর সিলভার ক্যাসেল রিসোর্টে ময়মনসিংহ বিভাগের ৪ জেলাসহ কিশোরগঞ্জ, টাঙ্গাইল ও গাজীপুরে কর্মরত বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তাদের সাথে বাংলাদেশ জুডিসিয়াল সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশন (বিজেএসএ) এর 'জুলাই বিপ্লবের অঙ্গীকার ও পৃথক বিচার বিভাগীয় সচিবালয়' শীর্ষক মতবিনিময় সভায় বক্তারা এসব কথা বলেন।
 
মতবিনিময় সভায় বাংলাদেশ জুডিসিয়াল সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ও নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল খুলনার বিচারক মো. আমিরুল ইসলামের সভাপতিত্বে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন ময়মনসিংহের সিনিয়র জেলা ও দায়রা জজ মো. জাকির হোসেন।
 
মতবিনিময় সভায়,বিচারকরা শ্রদ্ধার সঙ্গে জুলাই গণঅভ্যুত্থানের শহীদ ও আহতদের স্মরণ করে তাদের আত্মত্যাগকে গণতন্ত্র ও মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠায় একটি নতুন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের প্রতীক হিসেবে উল্লেখ করেন।
বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও নির্বাহী বিভাগের ওপর নির্ভরশীলতা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়। 
আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় বিচার বিভাগের সক্ষমতা ও স্বাধীনতা অপরিহার্য হলেও, বাংলাদেশের বিচার বিভাগ এখনও নির্বাহী বিভাগের ওপর বহুলাংশে নির্ভরশীল। বিচারকরা অভিযোগ করেন, তাদের পদ বৃদ্ধি, পদ-সৃজন এবং আদালতের অবকাঠামোগত উন্নয়নের ক্ষমতা নির্বাহী বিভাগের হাতে থাকায় বিচারিক কর্মঘণ্টার সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত হচ্ছে না।
 
বাংলাদেশ জুডিসিয়াল সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশন জ্যেষ্ঠতা, মেধা ও যোগ্যতার ভিত্তিতে জেলা আদালত থেকে সমতা রক্ষা করে উচ্চ আদালতে বিচারক নিয়োগের দাবি জানিয়েছেন তারা। বিচার বিভাগের বাজেট সংকট এবং নির্বাহী বিভাগের ওপর পূর্ণ নির্ভরতাকে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা খর্ব করার কারণ হিসেবে উল্লেখ করেন। অর্থনৈতিক দুর্বলতা আদালতের অবকাঠামোগত উন্নয়ন ও বিচারিক প্রক্রিয়াকে ব্যাহত করছে।  
 
বিচারকরা বিচার বিভাগের জন্য একটি পৃথক বাজেট কাঠামো এবং স্বাধীন বিচার বিভাগীয় সচিবালয় প্রতিষ্ঠার অপরিহার্যতা তুলে ধরেন। বিচারকদের মর্যাদা ও আর্থিক প্রণোদনা তাদের সাংবিধানিক গুরুদায়িত্বের সমতুল্য হওয়া উচিত বলেও তারা মত প্রকাশ করেন। ২০০৯ সালের স্কেলে স্থবির হয়ে থাকা জুডিসিয়াল ভাতার অচলাবস্থার সমালোচনা করে একটি পৃথক ও স্বাধীন পে-কমিশন গঠনের দাবি করেন।
 
 বিচার বিভাগের প্রাতিষ্ঠানিক স্বাধীনতা নিশ্চিত করার জন্য বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের অধীনে একটি পৃথক সচিবালয় প্রতিষ্ঠার কোনো বিকল্প নেই। ১৯৯৫ সালের ঐতিহাসিক মাসদার হোসেন মামলার রায়ে বিচার বিভাগকে নির্বাহী বিভাগ থেকে পৃথক করার নির্দেশনা দেন  হাইকোর্ট, যা আপিল বিভাগ ১৯৯৯ সালে বহাল রাখেন। 
বিচারকরা বলেন, ২০০৭ সালের ১ নভেম্বর বিচার বিভাগকে পৃথক ঘোষণা করা হলেও রায়ের ১২ দফার মধ্যে একটি মাত্র দফা পুরোপুরি বাস্তবায়িত হয়েছে। বিচার বিভাগের অর্থনৈতিক স্বাধীনতা, পৃথক সচিবালয় এবং বিচারকদের শৃঙ্খলা-সংক্রান্ত বিষয়সমূহ এখনো সম্পূর্ণভাবে বাস্তবায়িত হয়নি। 
 
 সংবিধানের ১০৯ ও ১১৬ (ক) অনুচ্ছেদ অধস্তন আদালত ও ট্রাইব্যুনালের ওপর হাইকোর্টের তত্ত্বাবধান ও নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা এবং বিচারিক স্বাধীনতা নিশ্চিত করলেও, ১১৬ অনুচ্ছেদ বিচারকদের নিয়ন্ত্রণ রাষ্ট্রপতির হাতে ন্যস্ত করেছে। কিন্তু এটি এখনও নির্বাহী বিভাগের পরামর্শে প্রয়োগ হয়। এর ফলে বিচারকদের পোস্টিং, বদলি, পদোন্নতি, ছুটি এবং শৃঙ্খলামূলক বিষয়গুলো এখনো নির্বাহী বিভাগের অধীনে রয়ে গেছে। এটি বিচার বিভাগের স্বাধীনতার মূলনীতিকে ব্যাহত করছে।  ১১৬ অনুচ্ছেদের পরিবর্তন করে এই ক্ষমতা সুপ্রিম কোর্টের হাতে ন্যস্ত করার এবং একটি পৃথক ‘বিচার বিভাগীয় সচিবালয়’ গঠনের আহ্বান জানান। ২০২৪ সালের ২১ সেপ্টেম্বর তিনি অধস্তন আদালতের বিচারকদের উদ্দেশ্যে প্রদত্ত অভিভাষণে বিচার বিভাগের জন্য যে ঐতিহাসিক রোডম্যাপ তুলে ধরেন তার উদ্ধৃতি দিয়ে বিচারকরা দাবি করেন, সুপ্রিম কোর্ট ও আইন মন্ত্রণালয়ের যৌথ এখতিয়ার সম্পূর্ণরূপে বিলোপ করে সুপ্রিম কোর্টের অধীনে অনতিবিলম্বে একটি পৃথক সচিবালয় প্রতিষ্ঠা করতে হবে। 
 
এছাড়াও ‘সুপ্রিম কোর্ট বিচারক নিয়োগ অধ্যাদেশ, ২০২৫’ প্রণীত হয়েছে এবং প্রধান বিচারপতি নির্বাচন কমিশন সচিবালয় ও জাতীয় সংসদ সচিবালয়ের মতো বিচার বিভাগের জন্য পৃথক সচিবালয় প্রতিষ্ঠার পূর্ণাঙ্গ প্রস্তাব আইন মন্ত্রণালয়ে প্রেরণ করেছেন। প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয় গঠনের বিষয়ে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ এবং সরকারের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়ার আশাবাদ ব্যক্ত করা হয়।
 
এসময় ময়মনসিংহ, শেরপুর, নেত্রকোনা, জামালপুর, কিশোরগঞ্জ, টাঙ্গাইল জেলার সিনিয়র জেলা ও দায়রা জজ এবং গাজীপুরের মহানগর দায়রা জজরা উপস্থিত ছিলেন। 
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত