সব স্বপ্ন শেষ করে দিল একটা গুলি,বাড়ি নির্মাণের জায়গায় হলো ছেলের কবর
নির্মলেন্দু সরকার বাবুল, দূর্গাপুর প্রতিনিধি
প্রকাশ : ০১ আগস্ট ২০২৪, ০৫:০২ বিকাল
জীবিকার তাগিদে দিনমজুরির কাজ করতেন জাকির হোসেন (২০)। কোটা সংস্কার আন্দোলন চলাকালে গত ২১ জুলাই গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হন। ওইদিনই নিহতের মরদেহ নিজ গ্রামের বাড়িতে নিয়ে আসে। পরদিন সকালে জানাজার পর মরদেহ তার নিজের উপার্জনের টাকায় কেনা ঘর তৈরির জায়গায় দাফন করা হয়।
ঘটনার সপ্তাহ পেরুলেও থামছে না ছেলে হারা মায়ের কান্না। একমাত্র ছেলের মৃত্যুতে এখন পাগলপ্রায় মা মিছিলি বেগম।
নিহত জাকির হোসেনের বাড়ি নেত্রকোনার দুর্গাপুর উপজেলার বাকলজোড়া ইউনিয়নের পূর্ব বাকলজোড়া গ্রামে। ওই গ্রামে মৃত ফজলু মিয়ার ছেলে সে।
রাজধানীর বাড্ডা নতুন বাজার এলাকায় ভাড়া বাসায় থাকতেন জাকির হোসেন ও তাঁর মা মিছিলি বেগম। জাকির দিনমজুরির কাজ করতো। এরই মধ্যে চিটাগং রোড এলাকায় ঠিকাদারের অধিনে ওয়াসার পানির লাইন মেরামতের কাজে যান জাকির। কাজ শেষে সেখান থেকে মায়ের কাছে বাসায় ফিরবে সেসময় কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে সংঘর্ষ আর সারা দেশেই কারফিউ। তাই আর ঢাকায় মায়ের কাছে ফেরা হয়নি। ২১ জুলাই রবিবার বিকেলে চিটাগং রোড এলাকায় একটি দোকানে যায় সেসময় গুলিবিদ্ধ হয়ে মৃত্যু হয় তাঁর। পরে অন্য সহকর্মীরা জাকিরের লাশ নিয়ে যান বাড্ডা নতুন বাজার এলাকায় মায়ের কাছে। মা রাতেই লাশ নিয়ে রওনা হন গ্রামের বাড়ি দুর্গাপুরের পূর্ব বাকলজোড়া গ্রামে। পরদিন সোমবার (২২ জুলাই) সকাল সাড়ে ১০টায় জানাজা হয় গ্রামে। পরে ছেলের উপার্জনের টাকায় বাড়ি-ঘর নির্মাণের জন্য কেনা জায়গায় দাফন করা হয় জাকির হোসেনের লাশ।
গত মঙ্গলবার (৩০ জুলাই) বিকেলে জাকিরের বাড়িতে গেলে দেখা যায়,গুলিতে প্রাণ হারানো ছেলের কাপড় হাতে নিয়ে কান্নাকাটি করছেন মা মিছিলি বেগম। কবরস্থানে গিয়েও ছেলেকে ডাকছেন "বাপ আই আমার কাছে আই,এইযে তোর কাপড় টা নিয়ে যা বাপ"
জানতে চাইলে মিছিলি বেগম জানান,স্বামী ফজলু মিয়া দরিদ্র দিনমজুর ছিলেন। ভিটেমাটি কিছুই ছিল না তাদের। স্বজনদের বাড়িতে বসবাস করতেন। ছেলে জাকিরের বয়স যখন ৫ বছর তখন হঠাৎ অসুস্থ হয়ে স্বামী মারা যান। স্বামী মারা যাওয়ার পর নিজের সম্বল বলতে একমাত্র ছেলে। গ্রামে জীবনযাপন করা সম্ভব হচ্ছিল না তাই ছোট জাকিরকে নিয়ে রাজধানীর বাড্ডা নতুন বাজার এলাকায় চলে যান। সেখানে গিয়ে রাস্তা থেকে ভাঙারি কুড়িয়ে,মানুষের বাসায় কাজ করে ছেলেকে বড় করতে থাকেন। ১৪-১৫ বছর বয়স হওয়ার পর কাজ শুরু করেন জাকির। এতে দুঃখ ঘুচতে শুরু করে তাঁর। ছেলের আয়ের টাকা দিয়ে সম্প্রতি গ্রামে বাড়ি তৈরির জন্য ৯ শতক জায়গা কেনেন। আর কিছুদিন পর থাকার জন্য একটা ঘর তৈরির চিন্তাও করছিলেন মিছিলি বেগম। কিন্তু হঠাৎ একটি গুলি জাকিরের জীবন কেড়ে নিল।
মিছিলি বেগম বলেন,রবিবার বিকেলে বাহিরে বের হয়েছিল চা খেতে। এরপরই গুলিতে মারা যায়। এরপর ছেলের লাশ নিয়ে রাতেই গ্রামের বাড়ি ফিরে ছেলের উপার্জনের টাকায় কেনা যে জায়গায় ঘর বানানোর কথা ছিল সেই জায়গাটাতেই কবর দেওয়া হয় তাকে।
মিছিলি বেগম আরও বলেন,"আমার এখন ডানেও কিছু নাই বামেও কিছু নাই। আল্লাহ একটা সন্তান দিছিলো এই সন্তানরে মানুষে মাইরা ফেলছে। সকালেও আমার সাথে ফোনে কথা কইছে আমার ছেলে। আর বিকেলেই দুনিয়া ছাইড়া চলে গেছে। মানুষ হয়েও আমার ছেলেরে কিভাবে মারলো? আমার আর কিছুই রইলো না,কে দেখবো এখন আমারে।"
নিহত জাকিরের খালতো ভাই এন্টাস মিয়া বলেন,"জাকিরের পিটে একটা গুলি লেগেছিল। মরার সময় জাকিরের গায়ে যে কাপড় পড়ানো ছিল ওটা নিয়েই খালাম্মা (জাকিরের মা) এখন সবসময়ই কান্নাকাটি করে। জাকিরের এমনভাবে চলে না কিছুতেই আমরা মেনে নিতে পারছি না।"
প্রতিবেশী আশাদ তালুকদার বলেন,ছেলেটাকে নিয়ে তার মা ছোট বেলা থেকেই অনেক কষ্ট করেছে। একমাত্র ছেলেকে হারিয়ে জাকিরের মা পাগলের মতো হয়ে গেছে। এখন তাঁর আর কেউ রইল না।
মিছিলি বেগমের জীবনের শেষ অবলম্বন ছিল একমাত্র ছেলে জাকির হোসেন। কিন্তু অকালে ছেলের প্রাণ চলে যাওয়ায় সব স্বপ্নই যেন শেষ হয়ে অন্ধকারে তাঁর দুনিয়া। বৃদ্ধ বয়সে কিভাবে কাটবে সামনের দিনগুলো,কোথায় যাবেন কি করবেন জানেন না তিনি। অন্যদিকে জাকিরের এমন মৃত্যু কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছে না আত্মীয়-স্বজন ও এলাকাবাসী।