ঢাকা, রবিবার, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ৭ পৌষ ১৪৩১
শিরোনাম

মুসলমানদের শাম অঞ্চল বিজয়ের ইতিহাস


  আরবান ডেস্ক

প্রকাশ :  ১১ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২:১৬ দুপুর

রাসুলুল্লাহ (সা.) তাঁর জীবদ্দশায় আরব উপদ্বীপের উত্তর-পূর্ব অঞ্চশের গোত্রগুলো এবং শামের বিরুদ্ধে বিজয় লাভের অভিপ্রায় ব্যক্ত করেন। কিন্তু তাঁর জীবদ্দশায় তার খুব সামান্যই বিজয় করা সম্ভব হয়েছিল। অষ্টম হিজরিতে মুসলিম বাহিনী দক্ষিণ জর্ডানের মুতা শহরে একটি অভিযান পরিচালনা করে। প্রকৃতপক্ষে শামে মুসলিম বিজয়ের সূচনা হয়েছিল খলিফা আবু বকর সিদ্দিক (রা.)-এর যুগে এবং তা পূর্ণতা লাভ করে খলিফা ওমর (রা.)-এর শাসনামলে। 

মুসলিম বিজয়ের তিন পর্যায়শামে মুসলমানদের বিজয় অর্জিত হয়েছিল তিনটি পর্যায়ে। তা হলো-

১. প্রথম পর্যায় (১২-১৩ হি.): এই সময়ে শামের প্রত্যন্ত ও গ্রাম অঞ্চলগুলো মুসলিমরা বিজয় করে এবং এই অঞ্চলের আরব গোত্রগুলো বশ্যতা স্বীকার করে।

২. দ্বিতীয় পর্যায় (১৩-১৫ হি.): এই পর্যায়ে এসে প্রকৃত সামরিক সংঘাতের সূচনা হয়। এই সময়ে দক্ষিণ ও মধ্য শামের প্রধান প্রধান শহরগুলো মুসলমানরা জয় করে। মুসলিম বাহিনীকে প্রতিহত করতে বাইজেন্টাইন সম্রাট শামে বিপুল পরিমাণ সৈন্য সমাবেশ ঘটান এবং মুসলিম বাহিনীর সঙ্গে তাদের ভয়াবহ ও রক্তক্ষয়ী একাধিক যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এসব যুদ্ধে মুসলিম বাহিনী বিজয় লাভ করে। এই পর্যায়ের দুটি গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধ হলো ‘তাবাকাতে ফাহাল’ যুদ্ধ (১৩ হি.) ও ইয়ারমুক যুদ্ধ (১৫ হি.)। দুটি যুদ্ধই আধুনিক জর্ডানে সংঘটিত হয়। এই যুদ্ধগুলোর মাধ্যমে সাম্রাজ্যের পূর্বাঞ্চলীয় প্রদেশগুলোর ওপর থেকে বাইজেন্টাইন সম্রাট নিয়ন্ত্রণ হারান।

৩. তৃতীয় পর্যায় (১৬-২৭ হি.): এই পর্যায়ে এসে মুসলমানরা পূর্বে বিজয় করা অঞ্চলে মুসলিম শাসন দৃঢ় করণে মনোযোগী হয়। পাশাপাশি তারা উত্তর সিরিয়া, ভূমধ্য সাগরের তীরবর্তী অঞ্চল এবং বায়তুল মুকাদ্দাসের মতো গুরুত্বপূর্ণ শহরগুলো বিজয় করে। সমগ্র শাম অঞ্চল মুসলিম শাসনাধীন হওয়ার পর তাঁকে পাঁচটি সামরিক অঞ্চলে বিভক্ত করা হয়।

আবু বকর (রা.)-এর যুগে শাম অভিযানই সলামের প্রথম খলিফা আবু বকর (রা.) তাঁর শাসনামলে শামে মোট পাঁচটি বাহিনী প্রেরণ করেন। তা হলো-

প্রথম বাহিনী: আবু বকর (রা.) সর্বপ্রথম খালিদ বিন সাঈদ বিন আস (রা.)-এর নেতৃত্বে শামে প্রথম মুসলিম বাহিনী প্রেরণ করেন। এই বাহিনীর সদস্য ছিলেন চার হাজার। পরবর্তীতে ইয়াজিদ ইবনে আবি সুফিয়ান (রা.)-কে তাঁর স্থলাভিষিক্ত করেন। তাঁর সাহায্যার্থে রাবিআ ইবনে আসওয়াদ (রা.)-কে পাঠান। তিনি এই বাহিনীর সদস্য সংখ্যা সাত হাজারে উন্নীত করেন। দামেস্ক বিজয় ছিল এই বাহিনীর চূড়ান্ত লক্ষ্য।

দ্বিতীয় বাহিনী: আবু বকর (রা.) সুরাহবিল ইবনে হাসানাহ (রা.)-এর নেতৃত্বে দ্বিতীয় বাহিনী প্রেরণ করেন। তাদের লক্ষ্য ছিল হুরানের রাজধানী বসরা। এই বাহিনীতে তিন থেকে চার হাজার সৈন্য ছিল। এই বাহিনী মাআন, কার্ক, মাদাব, বালকা ও বসরা জয় করে। এই বাহিনী মূলত বসরা অবরোধ করে এবং খালিদ বিন ওয়ালিদ (রা.) ইরাক থেকে এসে তা জয় করেন। 

তৃতীয় বাহিনী: বিখ্যাত সাহাবি আবু উবাইদাহ ইবনুল জাররাহ (রা.)-এর নেতৃত্বে তৃতীয় বাহিনী প্রেরণ করেন আবু বকর সিদ্দিক (রা.)। এই বাহিনীর সদস্য ছিল তিন থেকে চার হাজার। তাদের লক্ষ্য ছিল হিমস বিজয়। তারা ওয়াদিউল কুরা, হিজর, জাতুল মানার, জায়জা, মাআব ও জাবিয়ার পথ ধরে হিমসের দিকে এগিয়ে যায়। আবু বকর (রা.) তাদেরকে কোনো শহর অবরোধ করতে নিষেধ করেন।

চতুর্থ বাহিনী: আমর ইবনুল আস (রা.)-এর নেতৃত্বে চতুর্থ বাহিনী প্রেরণ করেন আবু বকর (রা.)। তাদের লক্ষ্য ছিল ফিলিস্তিন বিজয়। এই বাহিনীতে ছয় থেকে সাত হাজার সেনা ছিল। তারা লোহিত সাগরের তীরবর্তী অঞ্চল ধরে সম্মুখ পানে এগিয়ে যায়। তিনি আবু উবাইদা ইবনুল জাররাহ (রা.)-কে নির্দেশ দেন এই বাহিনীকে সাহায্য করার। 

পঞ্চম বাহিনী: ইকরামা ইবনে আবি জাহাল (রা.)-এর নেতৃত্বে পঞ্চম বাহিনী গঠন করেন। এই বাহিনীতে সাত হাজার সেনা ছিল। এদেরকে তিনি মদিনায় রিজার্ভ বাহিনী হিসেবে রেখে দেন।

উল্লেখযোগ্য, আবু বকর (রা.)-এর যুগে শামের কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিজয় হলো:

ক. মাওয়াব বিজয়: ১২ হিজরি বাইজেন্টাইনদের বিরুদ্ধে এই বিজয় অর্জিত হয়। এটা ছিল মুসলমানদের জয় করা প্রথম বাইজেন্টাইন শহর।খ. দাসিন বিজয়: ১২ হিজরি এই বিজয় অর্জিত হয়।গ. মারজু সাফার বিজয়: এই যুদ্ধে খালিদ ইবনে ওয়ালিদ ও খালিদ ইবনে সাঈদ (রা.) অংশগ্রহণ করেন। এটা ছিল বাইজেন্টাইনদের বিরুদ্ধে প্রথম বড় বিজয়।

ওমর (রা.)-এর যুগে শামের চূড়ান্ত বিজয়খলিফা আবু বকর (রা.) শামে যে অভিযান শুরু করেছিলেন ওমর ইবনুল খাত্তাব (রা.) তাকে পূর্ণতা দান করেন। তার আমলে দামেশকসহ শামের গুরুত্বপূর্ণ শহরগুলো বিজয় হয়। ইয়ারমুক বিজয়ের পর যখন রোমান বাহিনী ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছিল, তখন সেনাপতি আবু উবায়দা ইবনুল জাররাহ (রা.) ওমর (রা.)-এর পরামর্শে মুসলিম বাহিনীর একটি অংশ ফাহালে প্রেরণ করেন, একটি অংশকে হিমস ও দামেশকের মাঝে নিয়োগ করেন এবং নিজে দামেশকের দিকে এগিয়ে যান। 

মুসলিম বাহিনীর আগমনের সংবাদ শুনে রোমান সেনাপতি নিসরাত ইবনে নাসতুস শহরের দরজা বন্ধ করে বসে থাকে। অন্যদিকে মুসলিম বাহিনীর চার দিক থেকে দামেশক অবরোধ করে। যার একদিকে আবু উবায়দা (রা.), একদিকে আমর ইবনুল আস (রা.), একদিকে খালিদ ইবনে ওয়ালিদ (রা.) এবং অন্যদিকে ইয়াজিদ ইবনে আবি সুফিয়ান (রা.) অবস্থান করছিলেন। এভাবে ৭০ দিন মুসলিম বাহিনী দামেশক অবরোধ করে রাখে। অবশেষে ১৪ হিজরির রজব মাসে দামেশক জয় হলো। 

এরপর মুসলিম বাহিনী একে একে ফাহাল, মারজে রোম, হিমস, বাআলাবাক্কা, কিননাসরিন, হালাব, ইনতাকিয়া ও আজনাদাইন জয় করে। সব শেষে মুসলিম বাহিনী আমর ইবনুল আস (রা.)-এর নেতৃত্বে বায়তুল মুকাদ্দাসের দিকে অগ্রসর হয়। তাঁর সঙ্গে যোগ দেন আবু উবায়দা ও খালিদ ইবনে ওয়ালিদ (রা.)। 

রোমান বাহিনীর ধারাবাহিক পরাজয় ও মুসলিম বাহিনীর আগমনে বায়তুল মুকাদ্দাসবাসী মুসলমানদের সন্ধির প্রস্তাব দেয়। তারা শর্ত দেয়, স্বয়ং খলিফা উপস্থিত হলে তারা সন্ধির মাধ্যমে মুসলমানদের হাতে বায়তুল মুকাদ্দাস হস্তান্তর করবে। ওমর (রা.)-কে বিষয়টি জানালে তিনি তাতে সম্মতি দেন এবং স্বয়ং বায়তুল মুকাদ্দাসে উপস্থিত হন। এভাবেই মুসলিম বাহিনী সমগ্র শাম অঞ্চল ইসলামী খেলাফতের অধীন করে নেয়।

সূত্র: ফুতুহাতুশ শাম, খেলাফতে রাশেদা, ইসলামওয়ে ডটনেট ও ইসলাম হিস্টোরি

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত