তৃতীয় শ্রেণির শিক্ষকের হাত ধরে তৈরি প্রথম শ্রেণির নাগরিক!
জাকির আহমদ খান কামাল
প্রকাশ : ১১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০১:৫৮ দুপুর
যে শিক্ষা ব্যবস্থায় একটি নির্দিষ্ট মানদণ্ডের আলোকে শিক্ষাকে বিচার করা হয় সেটি হল মানসম্মত শিক্ষা। অন্যভাবে যে শিক্ষা বোধসম্পন্ন মানুষের জ্ঞানের বিকাশ ঘটায় এবং যার মাধ্যমে মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি এবং নৈতিক মূল্যবোধের বিকাশ ঘটে তা মানসম্পন্ন শিক্ষা।
অন্যদিকে প্রাথমিক শিক্ষার লক্ষ্য হচ্ছে "শিশুর শারীরিক মানসিক সামাজিক নৈতিক মানবিক নান্দনিক আধ্যাত্মিক ও আবেগ অনুভূতির বিকাশ সাধন এবং তাদের দেশাত্মবোধ বিজ্ঞান মনস্কতায় সৃজনশীলতায় ও উন্নত জীবনের স্বপ্নদর্শনে উদ্বুদ্ধ করা"।
প্রাথমিক শিক্ষার লক্ষ্যের সাথে জ্ঞানের যে বিষয়গুলো সম্পৃক্তআছে সবগুলো একজন শিক্ষককেই প্রদান করতে হয়।
সেদিক বিবেচনায় গুণগত শিক্ষার জন্য যে উপাদানটি সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ তা হচ্ছে মানসম্মত শিক্ষক। শিক্ষার মান উন্নয়নের জন্য ভালো শিক্ষাগত যোগ্যতার অধিকারী মানসম্পন্ন শিক্ষক নিয়োগ করতে হবে। শিক্ষকের জন্য মান-সম্মত বেতন কাঠামো কর্মকালীন প্রশিক্ষণ প্রতি পাঁচ বৎসর পর সঞ্জীবনী কোর্সের ব্যবস্থা, সেই সাথে তাদের মৌলিক অধিকারের বিষয়গুলো ও পেশাগত স্বাধীনতা প্রদান করতে হবে।
কেন মেধাবীরা শিক্ষকতা পেশায় আসছে না তার কারণ নির্ধারণ করা এবং সকল বিষয়ে সমতা আনয়ন করতে হবে। কারণ শিক্ষকরা চাকুরীর পাশাপাশি তৈরি করছেন অন্যসকল পেশাজীবি। একজন শিক্ষক বর্তমানে পে স্কেলের ১৩ তম গ্রেডে বেতন পেয়ে থাকেন। সম্মানের দিক থেকে তা চতুর্থ শ্রেণীর। একজন চতুর্থ শ্রেণীর শিক্ষককে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে জ্ঞানের সকল দিকের পূর্ণতাদিয়ে প্রথম শ্রেণীর নাগরিক তৈরি করা। এটা শুধু হাস্যকরই নয় উপহাসের বিষয়ও বটে। তারপরও থেমে নেই শিক্ষক সমাজ। তাদের সাধ্যমত দায়িত্ব পালন করেই যাচ্ছেন সেই শুরু থেকেই।
প্রধান শিক্ষক পদে একত্রিশ বৎসর দায়িত্ব পালন করে অনেক প্রাপ্তি অপ্রাপ্তি সেইসাথে অনেক তিক্ত অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হতে হয়েছে। এক কথায় বলতে গেলে *শিক্ষক যেন শিক্ষক নামের বনসাই*। আমার সাথে যারা ক্লারিকেল পোষ্টে চাকরি পেয়েছিলেন তারাও শেষজীবনে অফিসার হয়ে চাকরি জীবন শেষ করেছেন। অপর দিকে একজন শিক্ষককে যদি আজীবন শিক্ষক পদই বহন করতে হয় তাহলে শিক্ষকদের জন্য আলাদা বেতন কাঠামোর সুপারিশ থাকবে। প্রাথমিক স্তরে দুইটি স্কেল সহকারী ও প্রধান শিক্ষকের জন্য। মাধ্যমিক স্তরে দুইটি সহকারি শিক্ষক ও প্রধান শিক্ষকের জন্য। উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে প্রভাষক ও অধ্যক্ষের জন্য। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের দুটি স্কেল মোট ৮টি স্কেলের মধ্যে বেতন নির্ধারনে নীতিনির্ধারকদের সুদৃষ্টি কামনা করছি ।
কারিকুলাম সহ পাঠ্যপুস্তক সময় উপযোগী এবং মানসম্মত করা দরকার বলেও মনে করি। আমাদের দেশটাকে আমাদের চারটি অঞ্চলে ভাগকরা যায়। সমতল, চরাঞ্চল, হাওড় অঞ্চল ও পাহাড়ি অঞ্চল। অঞ্চলভেদে কারিকুলামের পার্থক্য থাকা দরকার। কারণ অঞ্চলভেদে শিক্ষার্থীদের চিন্তা চেতনায় ও প্রাকৃতিক পরিবেশে পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। পাঠ্যপুস্তকের বিষয়টা তো আরো সমস্যাপূর্ণ। নিম্নমানের কাগজ অস্পষ্ট ছবি যা শিক্ষার্থীদের পাঠ্যবইয়ে আকর্ষণ তৈরি করতে অক্ষম। প্রাথমিক স্তরের বইগুলো রচনা সম্পাদনা সংকলনে কোন শিক্ষক কর্মকর্তা বিভাগীয় কোন গবেষক এর নাম দেখতে পাওয়া যায় না। প্রাথমিক স্তরের পাঠ্যপুস্তক প্রাথমিক স্তরসংশ্লিষ্ট শিক্ষক কর্মকর্তা ও গবেষকদের নিয়ন্ত্রণে রচনা সম্পাদনা ও সংকলনের দায়িত্ব থাকলে হয়তো অসামঞ্জস্যতা অনেক ক্ষেত্রেই দূর হতে পারে।
প্রাথমিক স্তরে ডিজিটাল শ্রেণিকক্ষে ডিজিটাল পদ্ধতিতে পাঠদান এর ব্যাপারে গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। কিন্তু একজন শিক্ষককে পনের দিনের প্রশিক্ষণ দিয়ে দায়িত্ব দেওয়া হচ্ছে শ্রেণিকক্ষে ডিজিটাল পদ্ধতিতে পাঠদান করতে। তাতে কোন সুফল আসছে বলে মনে হচ্ছে না। প্রতিটি বিদ্যালয় সহকারী প্রধান শিক্ষক পদে আইসিটি শিক্ষক নিয়োগ দিয়ে একাডেমিক এর দায়িত্ব দিলে হয়তো প্রত্যাশা পূরনের দ্বারপ্রান্তে যাওয়া যেতে পারে।
উপজেলা পর্যায়ে সবচেয়ে বেশি কর্মী নির্ভর বিভাগ হল প্রাথমিক শিক্ষা বিভাগ। উপজেলা পর্যায়ে কৃষি, মৎস, প্রাণীসম্পদ বিভাগ জনবলের দিকথেকে অনেক কম হলেও তাদের একাধিক ক্যাডার সার্ভিস কর্মকর্তা বিদ্যমান। কিন্তু সবচেয়ে জনবল সমৃদ্ধ প্রাথমিক স্তরের কোন ক্যাডার সার্ভিসের কোন কর্মকর্তা নেই।
উপজেলা শিক্ষা অফিসার পদটি প্রথম শ্রেণি ক্যাডার করে, সহকারী উপজেলা শিক্ষা অফিসার প্রথম শ্রেণির নন ক্যাডার এবং প্রধান শিক্ষক দ্বিতীয় শ্রেণীর পদায়ন করে নিয়োগের ব্যবস্থা করলে উচ্চশিক্ষিত মেধাবীদেরকে প্রাথমিক শিক্ষায় ধরে রাখা যাবে বলে মনে করি। বাস্তবতা হচ্ছে প্রাথমিক স্তরের ১৩ তম গ্রেডের চাকুরী ছেড়ে অন্য বিভাগের ১৭ তম গ্রেডে চাকুরি পেলেও মেধাবী শিক্ষার্থীরা চলে যায়।
মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা বাস্তবায়নকল্পে মেধাবী শিক্ষার্থীদের ধরে রাখার উপযোগী পরিবেশ তৈরি করে প্রাথমিক শিক্ষাস্তর সাজানো বর্তমান সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত বলে মনেকরি।
জাকির আহমদ খান কামাল
শিক্ষক এবং কলাম লেখক
আজকের আরবান।