বুধবার, ২২ অক্টোবর ২০২৫, ৫ কার্তিক ১৪৩২
শিরোনাম

শিক্ষকদের হৃদয়ের কান্না ও সমাধানের আকুতি


  এ কে এম আজিজুর রহমান

প্রকাশ :  ১৬ অক্টোবর ২০২৫, ১০:১৬ দুপুর

বাংলাদেশের বেসরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের এমপিওভুক্ত শিক্ষক ও কর্মচারীদের আন্দোলন এখন শুধু একটি দাবির সংগ্রাম নয়, এটি তাদের হৃদয়ের কান্না, তাদের অসহায়ত্বের আর্তনাদ। তাদের দাবি—মূল বেতনের ২০ শতাংশ বাড়ি ভাড়া ভাতা, ১৫০০ টাকা চিকিৎসা ভাতা এবং ৭৫ শতাংশ উৎসব ভাতা—শুধু তাদের জীবনযাত্রার মান রক্ষার জন্য নয়, বরং শিক্ষা ব্যবস্থার ভিত মজবুত করার জন্য, আমাদের সন্তানদের ভবিষ্যৎ আলোকিত করার জন্য। কিন্তু যখন শিক্ষকরা রাস্তায় নেমে তাদের ন্যায্য অধিকারের কথা বলেন, তখন তাদের উপর টিয়ার গ্যাস, সাউন্ড গ্রেনেড আর ওয়াটার ক্যানন নেমে আসে। এই দৃশ্য কি আমাদের বিবেককে নাড়া দেয় না? যারা আমাদের সন্তানদের হাতে কলম ধরান, তাদের হাতে কেন কষ্ট আর অপমান?

শিক্ষকদের জীবনের গল্প হৃদয়বিদারক। বর্তমানে তাদের বাড়ি ভাড়া ভাতা মাত্র ১৫০০ টাকা, চিকিৎসা ভাতা ৫০০ টাকা, আর উৎসব ভাতা এতই তুচ্ছ যে তা দিয়ে একটি পরিবারের হাসি ফোটানো যায় না। ঢাকার মতো শহরে, যেখানে বাড়ি ভাড়া আর চিকিৎসার খরচ মেঘের মতো মাথার উপর ঝুলে থাকে, এই ভাতাগুলো শিক্ষকদের জন্য যেন একটি নিষ্ঠুর পরিহাস। একজন শিক্ষকের কথায় বোঝা যায় তাদের বেদনা: “আমরা ছাত্রদের স্বপ্ন দেখাই, কিন্তু আমাদের নিজেদের স্বপ্ন ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যাচ্ছে।” জুলাই বিদ্রোহের পর অনেক শিক্ষককে জোর করে পদত্যাগ করানো, হেনস্থা করা এবং বেতন বন্ধ করা হয়েছে। এই অবিচার তাদের জীবনকে আরও অন্ধকারে ঠেলে দিয়েছে। এমপিও জাতীয়করণ প্রত্যাশী জোটের সদস্য সচিব দেলোয়ার হোসেন আজিজি বলেন, “আমরা শুধু নিজেদের জন্য নয়, আমাদের ছাত্রদের ভবিষ্যৎ বাঁচাতে লড়ছি।”

আন্দোলনের দৃশ্য মর্মস্পর্শী। গত ১২ অক্টোবর জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে শান্তিপূর্ণ অবস্থানে শিক্ষকদের উপর পুলিশের হামলা আমাদের সবাইকে স্তব্ধ করেছে। শিক্ষকদের আহত দেহ আর ভাঙা হৃদয় নিয়ে শহীদ মিনারে অবস্থান, সচিবালয় অভিমুখে লং মার্চ এবং শাহবাগ মোড় অবরোধের ঘোষণা তাদের অটল সংকল্পের প্রমাণ। তারা বলছেন, “আমরা শিক্ষক, আমরা শান্তির পক্ষে। কিন্তু আমাদের কষ্ট কেউ দেখছে না।” এই আন্দোলন এখন শুধু শিক্ষকদের নয়, সারাদেশের মানুষের মনে সাড়া ফেলেছে।

কিন্তু এই দাবিগুলো কেন যৌক্তিক? কারণ শিক্ষকরা আমাদের সমাজের আলোকবর্তিকা, তবু তাদের জীবন অন্ধকারে ডুবে আছে। অন্য সরকারি খাতে বেতন বৃদ্ধি ২০-৩০ শতাংশ হলেও শিক্ষকদের জন্য মাত্র ৩ শতাংশ—এ কোন ন্যায়?  তাদের কষ্ট শুধু অর্থনৈতিক নয়, মানসিকও। যে শিক্ষক মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন, তিনি কীভাবে ছাত্রদের স্বপ্ন গড়বেন? মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্র ঠিকই বলেছে, “শিক্ষকদের দাবি মেনে নিয়ে সংলাপের মাধ্যমে সমাধান জরুরি।”

সরকারের পক্ষ থেকে বাড়ি ভাড়া ভাতা ৫০০ টাকা বাড়িয়ে ১৫০০ টাকা করা হয়েছে, কিন্তু এটি শিক্ষকদের কষ্টের কাছে তুচ্ছ। শিক্ষা উপদেষ্টা সি আর আবরার দাবিগুলো নীতিগতভাবে মেনে নেওয়ার কথা বলেছেন, কিন্তু বাজেটের অজুহাতে বাস্তবায়ন পিছিয়ে যাচ্ছে। পুলিশি হামলা এই হতাশাকে আরও গভীর করেছে। হাসনাত আবদুল্লাহর মতো নেতারা সরকারের ‘দ্বিমুখী’ নীতির সমালোচনা করছেন। তবু সরকার সংলাপের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, যা একটি আশার আলো।
                                                                                            
এই আন্দোলন শিক্ষার্থীদের পড়াশোনা ব্যাহত করছে, জনজীবনে অসুবিধা তৈরি করছে। কিন্তু শিক্ষকদের কষ্টের কথা ভাবলে তাদের এই লড়াইকে সমর্থন না করে পারা যায় না। তারা আমাদের সন্তানদের শিক্ষক, আমাদের সমাজের মেরুদণ্ড। তাদের কান্না আমাদের সবার। সরকারের উচিত তাদের সঙ্গে এখনই সংলাপে বসে, তাদের দাবি পূরণ করে শ্রেণিকক্ষে হাসি ফোটানো। শিক্ষকদের মর্যাদা আর শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎ রক্ষার জন্য এখনই সময় কাজের, শুধু কথার নয়। এই হৃদয়বিদারক সংকটে আমরা সবাই মিলে শিক্ষকদের পাশে দাঁড়াই- এটাই এখন আমাদের মানবিক দায়িত্ব।

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত