বুধবার, ২২ অক্টোবর ২০২৫, ৫ কার্তিক ১৪৩২
শিরোনাম

আন্তর্জাতিক প্রবীণ দিবস: বাংলাদেশ প্রেক্ষিত


  এ কে এম আজিজুর রহমান

প্রকাশ :  ০২ অক্টোবর ২০২৫, ০৪:১৮ দুপুর

প্রতিবছরের মতো এবছরও ১ অক্টোবর পালিত হচ্ছে আন্তর্জাতিক প্রবীণ দিবস। ১৯৯০ সালের ১৪ ডিসেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের গৃহীত সিদ্ধান্ত অনুযায়ী দিবসটি পালন করা হয়। প্রবীণ নাগরিকদের সুরক্ষা, অধিকার নিশ্চিতকরণ এবং বার্ধক্যজনিত সমস্যাগুলো সম্পর্কে বিশ্বব্যাপী জনসচেতনতা সৃষ্টি করাই এ দিবস পালনের মূল উদ্দেশ্য।

২০২৫ সালের প্রবীণ দিবসের প্রতিপাদ্য বিষয় হল - "Older Person Driving Local and Global Action : Our Aspiration, Our Well Being, Our Rights"।

বাংলাদেশে সরকারি স্তরে এর বাংলা প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করা হয়েছে :

 "একদিন তুমি পৃথিবী গড়েছো, আজ আমি স্বপ্ন গড়বো, সাথে তোমায় রাখবো আগলে"। এ উপলক্ষে বাংলাদেশ সরকারের সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় ও সমাজসেবা অধিদপ্তর র‌্যলী, আলোচনা সভা, প্রবীণদের স্বাস্থ্য ও অধিকার নিয়ে সচেতনতামূলক কার্যক্রমসহ বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। সাধুবাদ জানাই সরকারের এই উদ্যোগকে তবে বাংলাদেশের প্রবীণেরা অনেক সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছে এই নিয়ে একটু আলোকপাত না করলেই নয় 
বাংলাদেশেপ্রবীণরা প্রধানত চারটি ধরনের নির্যাতনের শিকার হন যেমন : মানসিক নির্যাতন

মানসিক নির্যাতন প্রবীণদের হেয় করা, অপমান করা, তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করা এবং অবজ্ঞা প্রদর্শন। প্রায় ৮৮% প্রবীণ এ ধরনের নির্যাতনের শিকার। অবহেলা : প্রবীণদের মৌলিক চাহিদা পূরণে উদাসীনতা। প্রায় ৮৩% প্রবীণ অবহেলার শিকার।

আর্থিক নির্যাতন : প্রবীণদের অর্থ বা সম্পদ থেকে বঞ্চিত করা। প্রায় ৫৪% প্রবীণ এ ধরনের নির্যাতনের শিকার।
শারীরিক নির্যাতন প্রবীণদের শারীরিক কষ্ট দেওয়া বা আঘাত করা। প্রায় ৪০% প্রবীণ শারীরিক নির্যাতনের শিকার।বাংলাদেশে প্রবীণ সুরক্ষায় আইন ও পদক্ষেপ বাংলাদেশে প্রবীণ নাগরিকদের সামাজিক নিরাপত্তা বিধানের জন্য গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের ১৫(ঘ) অনুচ্ছেদে অসহায় প্রবীণদের জন্য সাংবিধানিক অঙ্গীকার সন্নিবেশিত করা হয়েছে:

পিতা-মাতা ভরণপোষণ আইন, ২০১৩ কার্যকরভাবে বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। দারিদ্র্য-পীড়িত প্রবীণদের জন্য কৃষি ঋণ বা আয়বৃদ্ধিমূলক কর্মকাণ্ডে সহজ শর্তে ঋণ প্রদানের মতো পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে।

বাংলাদেশ সরকার ১৯৯৭-৯৮ অর্থবছরে বয়স্ক ভাতা কর্মসূচি প্রবর্তনের মাধ্যমে প্রবীণদের কল্যাণে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নিয়েছে। ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গিতে প্রবীণদের মর্যাদা‌ বাংলাদেশ একটিধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যময় দেশ। এদেশের প্রধান সব ধর্মেই প্রবীণদের প্রতি সম্মান ও সেবাদানকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে: ইসলাম ধর্মে পবিত্র কোরআনে আল্লাহর ইবাদতের পাশাপাশি পিতামাতার সঙ্গে সদাচরণের কঠোর নির্দেশ দেওয়া হয়েছে (সূরা বনি ইসরাইল, আয়াত: ২৩)। হাদিসে প্রবীণদের শ্রদ্ধা ও নবীনদের স্নেহ করাকে রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর সুন্নাত বলা হয়েছে।‌ হিন্দু ধর্মে পরিবারের প্রবীণদের সম্মান করা, তাদের দেখাশোনা করা এবং তাদের প্রতি কর্তব্য পালন করাকে প্রত্যেক ব্যক্তির দায়িত্ব ও ধর্মীয় কর্তব্য হিসেবে দেখা হয়। পূর্বপুরুষদের প্রতি শ্রদ্ধা ('শ্রাদ্ধ' অনুষ্ঠান) একটি গুরুত্বপূর্ণ অনুশীলন।
বৌদ্ধ ধর্মে প্রবীণ ব্যক্তির সেবা করা একটি গুরুত্বপূর্ণ নৈতিক কর্তব্য এবং সুখ অর্জনের একটি পথ বলে বিবেচিত। গৌতম বুদ্ধ দুর্বল ও অসুস্থদের সেবার ওপর জোর দিয়েছিলেন।

খ্রিস্টান ধর্মে প্রবীণদের সম্মান ও সেবা করা একটি গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় দায়িত্ব। প্রবীণদের জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার জন্য তাদের মূল্যায়ন এবং তাদের প্রয়োজনীয়তা পূরণের উপর গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। তারপরেও প্রবীণদের প্রতি অবজ্ঞা আশঙ্কাজনক ভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে উদাহরণ হিসেবে বৃদ্ধনিবাসে অবস্থানরত অনেক অনেক শ্রদ্ধাভাজন এক সময়কার গুরুত্বপূর্ণ  ব্যক্তিবর্গের আকুতিতে সন্তানদের দায়িত্ববোধের চিত্রটি ফুটে উঠে।

প্রবীণদেরকে "বোঝা" ভাবা; প্রয়োজনের সময় আর্থিক সহায়তা না করা; পারিবারিক সম্পদ থেকে বঞ্চিত করা।

সেবা ও যত্নের অভাব বার্ধক্যজনিত রোগে ভুগলেও যথাযথ চিকিৎসা ও সেবা না পাওয়া; শারীরিক অসুবিধা থাকা সত্ত্বেও দৈনন্দিন কাজে (হাঁটা-চলা, ওষুধ খাওয়া) সহায়তা না করা ব্যক্তি পর্যায়ের অবহেলা । সামাজিক ও প্রাতিষ্ঠানিক অবহেলা প্রবীণদের প্রতি অমানবিক আচরণ কেবল ব্যক্তিগত পর্যায়ে সীমিত নেই, এটি একটি বিস্তৃত সামাজিক ও প্রাতিষ্ঠানিক সমস্যা যেমন পরিবারিক কাঠামোর পরিবর্তন: ঐতিহ্যবাহী যৌথ পরিবার ব্যবস্থার ভাঙন প্রবীণদের জন্য সহায়তা ব্যবস্থাকে দুর্বল করেছে। অনেক প্রবীণই এখন একাকী, নিঃসঙ্গ জীবন যাপন করছেন। অপ্রতুল রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধা: সরকার বয়স্কভাতা, প্রবীণ নীতিমালা এবং পিতা-মাতার ভরণপোষণ আইন প্রণয়ন করলেও এসবের বাস্তবায়ন সীমিত। বয়স্কভাতার পরিমাণ (মাসিক ৬০০ টাকা) জীবনযাত্রার ব্যয় মেটানোর জন্য অপ্রতুল।

বিশেষায়িত স্বাস্থ্যসেবার অভাব: দেশে প্রবীণদের জন্য বিশেষায়িত (জেরিয়াট্রিক) চিকিৎসাসেবার ব্যবস্থা খুবই কম। বিদ্যমান সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোও পর্যাপ্ত রাষ্ট্রীয় অনুদানের অভাবে তাদের কার্যক্রম সঠিকভাবে সম্প্রসারণ করতে পারছে না।

প্রবীণদের অবস্থার উন্নয়নে ব্যক্তিগত, সামাজিক ও প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে সচেতনতা এবং পদক্ষেপ প্রয়োজন। ব্যক্তিগত পর্যায়ে পরিবারে প্রবীণ সদস্যদের মতামতের মূল্য দিতে হবে, তাদের সাথে ধৈর্য্য ও সম্মানের সাথে আচরণ করতে হবে এবং তাদের মানসিক সুস্থতার বিষয়ে খেয়াল রাখতে হবে।প্রবীণদের অভিজ্ঞতাকে জাতীয় সম্পদ হিসেবে মূল্যায়ন করতে হবে। তাদের জন্য বিনামূল্যে বা স্বল্পমূল্যে চিকিৎসাসেবা, বিনোদন ও সামাজিকীকরণের সুযোগ তৈরি করতে হবে । সরকারি নীতিমালা জোরদার করা, বয়স্কভাতার পরিমাণ বাড়ানো, প্রবীণবান্ধব সরকারি সুযোগ-সুবিধা (যেমন- গণপরিবহনে সংরক্ষিত আসন) নিশ্চিত করা এবং বিশেষায়িত স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করা প্রয়োজন। প্রবীণদের প্রতি সদয় ও সম্মানজনক আচরণ একটি সুস্থ ও নৈতিক সমাজের অন্যতম ভিত্তি। তাদের কল্যাণে ব্যক্তিগত সচেতনতা এবং রাষ্ট্রীয় পদক্ষেপ—উভয়ই সমান গুরুত্বপূর্ণ।

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত