৭৯ শতাংশ মানুষ মনে করেন, নির্বাচিত সরকার দেশ ভালো চালাতে পারে
আরবান ডেস্ক
প্রকাশ : ১২ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৮:৩৩ রাত
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের চেয়ে নির্বাচিত রাজনৈতিক সরকার দেশ ভালোভাবে পরিচালনা করতে পারে বলে দেশের ৭৯ শতাংশ মানুষ বিশ্বাস করেন। ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (বিআইজিডি) ‘পালস সার্ভের’ দ্বিতীয় ধাপের জরিপের ফলাফলে এমন চিত্র উঠে এসেছে। আর ১৫ শতাংশ মানুষ এই মতের বিপক্ষে।
আজ বৃহস্পতিবার সকালে রাজধানীর প্রেস ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশে (পিআইবি) আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে এই জরিপের ফলাফল প্রকাশ করা হয়। বিআইজিডির আয়োজনে ‘অভ্যুত্থান-পরবর্তী বাংলাদেশ: মানুষ কী ভাবছে’ শীর্ষক এই অনুষ্ঠানে প্রতিষ্ঠানটির গবেষণা সহযোগী শেখ আরমান তামিম অনুষ্ঠানে জরিপের ফলাফল তুলে ধরেন। এই জরিপে সারাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলের ৪ হাজার ১৫৮ জনের সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়।
অনুষ্ঠানের স্বাগত বক্তব্যে বিআইজিডি’র নির্বাহী পরিচালক ড. ইমরান মতিন বলেন, ‘দারিদ্র্য দুরীকরণে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হলেও অনেকেই এখনো আর্থিক দুরাবস্থায় বসবাস করছেন এবং আবারও দারিদ্র্যের চক্রে ফিরে যাওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছেন। তবে সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীকে আরও জোরদার ও বিস্তৃত করে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়ন এবং দারিদ্র্য বিমোচন করা সম্ভব।’
তার বক্তব্যের পরপরই জরিপের ফলাফল উপস্থাপন করা হয়। এরপর অনুষ্ঠানে আগত অতিথিরা জরিপের ফলাফলের ওপর তাদের আলোচনা শুরু করেন।
বিআইজিডি’র সিনিয়র রিসার্চ ফেলো ড. মির্জা এম হাসান বলেন, ‘জুলাই বিপ্লবের পর আগস্টে মানুষের আশা বেড়েছিল। তবে পরবর্তীতে বিভিন্ন পরিস্থিতিতে এই আশা পূরণ না হওয়ায় জনসাধারণ তাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত। প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারের সময় সরকারকে জনগণের এই উদ্বেগের কথা বিবেচনা করতে হবে।’
পিআইবির চেয়ারপারসন অধ্যাপক ফিরদৌস আজিম বলেন, ‘অভ্যুত্থানে সক্রিয়ভাবে অংশ নেওয়া সত্ত্বেও আমার অনেক ছাত্রী আমাকে বলেছে, তারা এখন পাবলিক প্লেসে নিরাপদ বোধ করছে না। নারীদের নিরাপত্তাহীনতা বেড়েছে। এ সমস্যা সমাধানে আমাদের একটি নতুন শক্তি গড়ে তোলা প্রয়োজন।’
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ বলেন, ‘জনগণ অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছ থেকে একটি নির্দিষ্ট পরিকল্পনা চায়, যাতে তারা বুঝতে পারে সরকার কীভাবে এবং কী কী কাজ করে দেশের উন্নতি করবে।’
পিআইবির মহাপরিচালক ফারুক ওয়াসিফ বলেন, ‘অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে অনেক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হয়েছে এবং এখনও হচ্ছে। অভ্যুত্থানের পর জনগণের উচ্ছ্বাস তাদের প্রত্যাশাকেও অনেক বাড়িয়ে দিয়েছে। কিন্তু বাস্তবতার কারণে জনগণের সেই প্রত্যাশা পূরণ হয়নি। জনমনে এত প্রত্যাশা জন্মানোর পেছনে সরকারের বার্তার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে এবং এই বার্তা পুনর্মূল্যায়ন করা জরুরি।’
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম বলেন, ‘আমরা জানি যে, বর্তমানে দেশে বেশকিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে তবে এটাও মনে রাখা দরকার, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার যখন দায়িত্ব নেয়, তখন দেশের অর্থনীতি ও রাজনীতি ভঙ্গুর অবস্থায় ছিল। এই সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর মাত্র চার মাস অতিবাহিত হয়েছে। এই সংক্ষিপ্ত সময়কালে একাধিক জটিল সমস্যার সমাধান করা অত্যন্ত কঠিন বটে। তবে আমরা সকলে মিলে দেশের উন্নয়নের লক্ষ্যে কাজ করার জন্য দৃঢ় প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।’
এ বছরের অক্টোবরে পরিচালিত ‘পালস সার্ভে ২য় ধাপ: অক্টোবর ২০২৪’ সমীক্ষায় দেখা গেছে, উত্তরদাতাদের ৫৬ শতাংশ বিশ্বাস করেন, বাংলাদেশ রাজনৈতিকভাবে সঠিক পথে অগ্রসর হচ্ছে। অন্যদিকে ৩৪ শতাংশ মনে করেন দেশ ভুল পথে যাচ্ছে। এই ফলাফলগুলি ২০২৪ সালের আগস্টে করা পালস সার্ভের ১ম ধাপে পাওয়া ফলাফলের তুলনায় কিছুটা ভিন্ন। পূর্ববর্তী সমীক্ষায় উত্তরদাতাদের ৭১ শতাংশ বাংলাদেশের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ সম্পর্কে আশাবাদ ব্যক্ত করেছিলেন। তখন দেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে হতাশা প্রকাশ করেছিলেন ১২ শতাংশ মানুষ।
এ সমীক্ষায় বাংলাদেশের অর্থনীতি সঠিক পথে যাচ্ছে কি না এ ব্যাপারে যখন জিজ্ঞাসা করা হয়, তখন ৪৩ শতাংশ উত্তরদাতা জানিয়েছেন বাংলাদেশের অর্থনীতি সঠিক পথে রয়েছে। অন্যদিকে ৫২ শতাংশ মনে করেন, অর্থনীতি সঠিক পথে চলছে না। অর্থ্যাৎ অর্থনীতি নিয়ে জনগণের আশাবাদ ২০২৪ সালের আগস্টের তুলনায় অক্টোবরে এসে কমে গেছে। উল্লেখ্য, ২০২৪ সালের আগস্টে ৬০ শতাংশ উত্তরদাতা মনে করেছিলেন বাংলাদেশ সঠিক পথে যাচ্ছে, আর ২৭ শতাংশ মনে করেছিলেন ভুল পথে যাচ্ছে।
সমীক্ষায় দেখা গেছে, ২০২৪ সালের অক্টোবর মাসে দেশের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো নিয়ে জনসাধারণের মতামতে বেশকিছু পরিবর্তন হয়েছে। তা সত্ত্বেও যেখানে ৬৮ শতাংশ উত্তরদাতা আগস্ট মাসে বিশ্বাস করতেন রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক দুদিক থেকেই দেশ সঠিক পথে অগ্রসর হচ্ছে, সেখানে তা কমে দাঁড়িয়েছে ৩৭ শতাংশে। অন্যদিকে, আগস্টে ১৭ ভাগ উত্তরদাতা মনে করতেন যে দেশ ভুল পথে যাচ্ছিল। এই সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৯ শতাংশে।
দেশবাসী মনে করেন, দেশের সামনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হল অর্থনৈতিক বিভিন্ন ইস্যু। ৬৭ শতাংশ উত্তরদাতা মূল্যবৃদ্ধি, মন্দাসহ বিভিন্ন অর্থনৈতিক সমস্যাকে সবচেয়ে বড় সংকট হিসেবে চিহ্নিত করেছেন।
কোটা সংস্কার আন্দোলনের একদফা আন্দোলনে পরিবর্তিত হওয়ার ব্যাপারে জনগণের সমর্থন কতটুকু স্থানান্তরিত হয়েছে তা বোঝার জন্য জরিপে প্রশ্ন করা হয়েছিল। ফলাফলে দেখা গেছে, আগস্ট মাসে ৮৩ শতাংশ মানুষ আন্দোলনকে সমর্থন করলেও সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাসে এসে এই সমর্থন দাঁড়িয়েছে ৭৫ শতাংশে। অন্যদিকে, আগস্ট মাসে ১০ ভাগ মানুষ বলেছেন তারা এ আন্দোলনকে সমর্থন করেননি যা অক্টোবরে এসে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২১ শতাংশে।
দেশের মধ্যেকার সহনশীলতার কি অবস্থা, তা জানতে সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষের মতামত নেওয়া হয়। এক্ষেত্রে ৪৬ শতাংশ উত্তরদাতা বলেছেন, সহনশীলতা বৃদ্ধি পেয়েছে। অন্যদিকে, ৩১ শতাংশ উত্তরদাতা বলেছেন সহনশীলতা হ্রাস পেয়েছে এবং ২০ শতাংশ উত্তরদাতা বলেছেন সহনশীলতার ব্যাপারটি অভ্যুত্থানের আগে যেমন ছিল, তেমনই আছে।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকার কতদিন ক্ষমতায় থাকবে- তা নিয়ে জনগণের মধ্যে মতভেদ রয়েছে। জরিপে অংশগ্রহণকারী ৪০ শতাংশ মনে করেন, এ সরকারকে কমপক্ষে দুই বছর ক্ষমতায় থাকতে হবে। অন্যদিকে ৪৬ শতাংশ মনে করেন এক বছর বা তার কম সময়ই যথেষ্ট। উল্লেখ্য, তিন বছর বা তার বেশি সময়ের জন্য অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে ক্ষমতায় রাখার ব্যাপারে জনসমর্থন আগের তুলনায় কমে এসেছে। এ বছরের আগস্টে ৩৮ শতাংশ যেখানে এই তিনবছর মেয়াদকে সমর্থন করেছিল, সেখানে অক্টোবরে তা কমে হয়েছে ২৪শতাংশ। অপরদিকে, ৫ শতাংশ মনে করেন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উচিত অবিলম্বে ক্ষমতা ছেড়ে দেয়া।
বিভিন্ন ইস্যুতে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সিদ্ধান্ত গ্রহণ বা, বর্জনের ব্যাপারেও সমীক্ষায় জানতে চাওয়া হয়। এব্যাপারে ৪৬ শতাংশ উত্তরদাতা মনে করেন, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার জনগণের মতামতের ভিত্তিতেই সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে। অন্যদিকে, ২৪ শতাংশ মনে করেন, সরকার নিজের সিদ্ধান্তে অটল থাকতে পারেনি এবং ২১ শতাংশ মনে করেন, সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে যথাযথ চিন্তা-ভাবনা করা হয়নি। আবার, সরকার কি দৃঢ়ভাবে দেশ চালাচ্ছে—এই প্রশ্নের জবাবে ৫৬ শতাংশ উত্তরদাতা মনে করেন, হ্যাঁ, সরকার দৃঢ়ভাবে দেশ চালাচ্ছে। কিন্তু ৩৯ শতাংশ উত্তরদাতা এই মতের বিপক্ষে।
জরিপে জিজ্ঞাসা করা হলে জানা যায়, ৭৯ শতাংশ মানুষ বিশ্বাস করেন যে নির্বাচিত একটি রাজনৈতিক সরকার একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের চেয়ে দেশ ভালভাবে পরিচালনা করতে পারে। অন্যদিকে, ১৫ শতাংশ মানুষ এই মতের বিপক্ষে।
আজকের এ অনুষ্ঠানের অতিথিদের মধ্যে আরও উপস্থিত ছিলেন ড. আহমেদ আহসান, পরিচালক, পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট (পিআরআই) ও মোহাম্মদ আয়নুল ইসলাম, সহযোগী অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। পুরো অনুষ্ঠানটি পরিচালনা করেন সৈয়দা সেলিনা আজিজ, ফেলো অব প্র্যাকটিস, ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অফ গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভলপমেন্ট (বিআইজিডি), ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়।
জরিপে দেখা গেছে, সাধারণ মানুষ বর্তমান সরকারের কাজকর্মকে ০ থেকে ১০০ স্কেলে ৬৮ দিয়েছেন। ২০২৪ সালের আগস্টে এই রেটিং ছিল প্রায় ৭৫।