৭ লাখ কপি পাঠ্যবই নিম্নমানের কাগজে ছাপানোর অভিযোগ
আরবান ডেস্ক
প্রকাশ : ২৬ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৪:১৬ দুপুর
শিক্ষাপঞ্জি মেনে এবারও পয়লা জানুয়ারি শুরু হবে প্রাথমিক ও মাধ্যমিকের শিক্ষাবর্ষ। তবে বছরের প্রথম দিনে শিক্ষার্থীদের হাতে বই পৌঁছে দেওয়া নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে। শিক্ষার্থীদের হাতে মানসম্মত বই তুলে দিতে সরকার কঠোর অবস্থানে থাকলেও অধিক মুনাফার লোভে রাতের আঁধারে কিছু ছাপাখানা নিম্নমানের কাগজে পাঠ্যবই ছাপানোর অভিযোগ উঠেছে।
নিম্নমানের কাগজে ছাপা এবং বাঁধাইয়ে ত্রুটিসহ বিভিন্ন অনিয়মের কারণে ৭ লাখ কপি পাঠ্যবই বাতিল করেছে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি)। ফলে বিনামূল্যের পাঠ্যবই ছাপা ও বিতরণ নিয়ে ‘ঘোর সংকটে’ পড়েছে সরকার। এ অবস্থায় সময়মতো সব বই শিক্ষার্থীদের হাতে তুলে দেওয়া নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে। তবে এনসিটিবি সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ২০ জানুয়ারির মধ্যে শিক্ষার্থীদের সব বই সরবরাহ করতে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন তারা।
জানা গেছে, এখন পর্যন্ত প্রথম থেকে তৃতীয় শ্রেণির পাঠ্যবই ছাপার অগ্রগতি ভালো। তবে দশম শ্রেণির বই ছাপার কাজ এগিয়ে নিলেও ষষ্ঠ থেকে নবমের বই নিয়ে নাজুক অবস্থায় রয়েছে। রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর শিক্ষাক্রম পরিবর্তন, বই পরিমার্জন, আগের দরপত্র বাতিল করে নতুন দরপত্র দেওয়াসহ ছাপাসংক্রান্ত কাজে বিলম্বের কারণে এ পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। যদিও জানুয়ারির মধ্যে শিক্ষার্থীদের হাতে সব বই পৌঁছে দিতে এনসিটিবির কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সাপ্তাহিকসহ সব ছুটি বাতিল ঘোষণা করা হয়েছে।
এনসিটিবি, ছাপাখানার মালিক ও মুদ্রণ শিল্প সমিতি সূত্র জানা গেছে, এবার প্রাক-প্রাথমিক থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের জন্য প্রায় ৪০ কোটি ১৬ লাখ বই ছাপানোর কাজ চলমান। এর মধ্যে প্রাক-প্রাথমিক ও প্রাথমিকের বইয়ের সংখ্যা ১২ কোটি ৮ লাখ ৬৭ হাজার ৭৫২টি। ষষ্ঠ থেকে নবম শ্রেণির অর্থাৎ মাধ্যমিক পর্যায়ের বইয়ের সংখ্যা ২৮ কোটি ৬ লাখ ২২ হাজার ৩৩৭টি। এ ছাড়া দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের জন্য সাড়ে ৮ হাজারের বেশি ব্রেইল বই ছাপা হচ্ছে। অন্যদিকে শিক্ষকদের জন্য দেওয়া হবে প্রায় ৪১ লাখ ‘শিক্ষক সহায়িকা’।
২৫ ডিসেম্বর বিকাল পর্যন্ত ৪ কোটিরও কিছু কম সংখ্যক পাঠ্যবই ছাপা ও বাঁধাইয়ের কাজ সম্পন্ন হয়েছে। সে হিসাবে এখনও ৩৬ কোটির বেশি বই ছাপানো ও বাঁধাই বাকি।
এনসিটিবি কর্মকর্তাসহ সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, গত এক মাসে ছাপাখানাগুলো পরিদর্শনে গিয়ে নিম্নমানের কাগজে ছাপানো বই হাতেনাতে ধরা হয়। দেখা গেছে, কোনো ছাপাখানায় বইয়ের কাগজ নিম্নমানের। আবার কোনোটির বইয়ের বাঁধাই ঠিক নেই। কিছু ছাপাখানায় কাগজের বাস্টিং ফ্যাক্টর কম, বইয়ের সামনের ও পেছনের মলাট খুলে যাচ্ছে। এমন সাত লক্ষাধিক নিম্নমানের পাঠ্যবই ও বইয়ের ফর্মা কেটে বিনষ্ট করা হয়েছে।
এনসিটিবি সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে প্রাথমিক ও মাধ্যমিকের ৪০ কোটি ১৪ লাখ ৯৫ হাজার ৮৪১টি পাঠ্যবই ছাপানোর কাজ চলমান। এখন পর্যন্ত প্রথম থেকে তৃতীয় শ্রেণির পাঠ্যবই ছাপার অগ্রগতি ভালো। তাই প্রাথমিকের সব এবং মাধ্যমিকের ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণির শুধু বাংলা, ইংরেজি ও গণিত বই ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে স্কুলগুলোতে পৌঁছানো সম্ভব হবে।
অন্যদিকে জানুয়ারির ১০ তারিখের মধ্যে মাধ্যমিকের অন্য পাঁচটি বই এবং জানুয়ারির ২০ তারিখের মধ্যে মাধ্যমিকের বাকি সব বই পৌঁছে দেওয়ার লক্ষ্যে কাজ করা হচ্ছে। ফলে আগামী বছরের শুরুতে সব শ্রেণির শিক্ষার্থীর হাতে সব বই দেওয়া যাচ্ছে না।
৭ লাখ কপি পাঠ্যবই বাতিল হওয়া এবং সময়মতো বই না ছাপানোর ব্যাপারে এনসিটিবি এক কর্মকতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, এবার জুন মাসে বই ছাপার কার্যক্রম শুরু হয়। পাঠ্যবই ছাপানোর জন্য ১১৬টি মুদ্রণ প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয় এনসিটিবি। সরকারের কঠোর মনোভাবের কথা বুঝতে পেরে ছাপাখানার মালিকরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে সিন্ডিকেট করেন। প্রায় ৪০ ভাগ টেন্ডারে একজনের বেশি টেন্ডার জমা দেয়নি।
তিনি জানান, বিভিন্ন প্রেসে কাগজ ও ছাপা হওয়া বইয়ের মান যাচাইয়ের জন্য তৃতীয় পক্ষের দুটি ইনস্পেকশন এজেন্সি নিয়োগ দেয় সরকার। এ ছাড়া বরাবরের মতোই সরকারের গোয়েন্দা সংস্থাগুলো কাজ করছে। একই সঙ্গে শিক্ষা মন্ত্রণালয় মুদ্রণ প্রতিষ্ঠানের ছাপার কার্যক্রম সরেজমিন তদারকি করতে নতুন করে বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডারের আরও ১৫০ জন শিক্ষককে দায়িত্ব দেয়। তারা নিয়মিত সংযুক্ত মুদ্রণ প্রতিষ্ঠানের বাস্তবিক অবস্থা, কাগজ সরবরাহ, টেস্টিং রিপোর্ট, ছাপার মান, প্রতিদিনের কর্মপরিকল্পনা, বই ছাপার অগ্রগতি ও সরবরাহ প্রতিবেদন ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে পাঠাচ্ছেন। তবুও অধিক মুনাফার লোভে কিছু কিছু প্রতিষ্ঠান নিম্নমানের কাগজে পাঠ্যবই ছাপাচ্ছেনÑএমন প্রমাণ পাওয়া গেছে।
অভিযোগ রয়েছে, আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পরও তারা এনসিটিবির কিছু কর্মকর্তার সঙ্গে যোগসাজশ করে টেন্ডারে সর্বনিম্ন দর দিয়ে বই ছাপার কাজ বাগিয়ে নিয়েছেন। অতীতে দেখা গেছে, এক পৃষ্ঠার ছবি আরেক পৃষ্ঠায় দেখা যায়। আবার কাগজের নির্ধারিত পুরুত্ব ও উজ্জ্বলতা অনুযায়ী সব বই পাওয়া যাবে কি না তা নিয়েও শঙ্কা আছে। বছরের শেষ সময়ে একশ্রেণির মুদ্রণকারী নিম্নমানের পাঠ্যবই দেওয়ার পাঁয়তারা করে থাকেন। এবারও এমন অভিযোগ উঠেছে।
দেশে উৎসব করে বছরের প্রথম দিন শিক্ষার্থীদের হাতে পাঠ্যবই তুলে দেওয়ার রেওয়াজ শুরু হয় ২০১০ সালে। তবে বিগত দুই-তিন বছর শিক্ষাবর্ষের শুরুতে ১ জানুয়ারি উৎসব করে বই বিতরণ শুরু হলেও কিছু কিছু ক্ষেত্রে সব শিক্ষার্থীর হাতে সব নতুন বই দেওয়া যায়নি।
এদিকে সরকারের বিনামূল্যের পাঠ্যবই মুদ্রণের জন্য বাংলাদেশ মুদ্রণ শিল্প সমিতির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান জুনায়েদুল্লাহ আল মাহফুজ আগামী ২৫ মার্চ পর্যন্ত সময় চেয়ে শিক্ষা উপদেষ্টা বরাবর চিঠি পাঠিয়েছিলেন। এ নিয়ে ব্যাপক আলোচনার পর তড়িঘড়ি করে রোববার সংবাদ সম্মেলন ডেকে ক্ষমা চেয়েছেন তিনি।
শিক্ষা উপদেষ্টাকে দেওয়া চিঠিতে জুনায়েদুল্লাহ আল মাহফুজ লেখেন, ২০২৫ সালের পাঠ্যপুস্তক মুদ্রণের জন্য আগামী ২৫ মার্চ পর্যন্ত সময় প্রয়োজন। এর আগে পাঠ্যবই ছাপা শেষ করা সম্ভব নয়।
একই সঙ্গে টেন্ডারের শর্ত অনুযায়ী ৫০ শতাংশ বই জানুয়ারিতে সরবরাহের শর্ত রহিত করা এবং পুস্তক মুদ্রণের আগে আংশিক বিল পরিশোধেরও দাবি জানান তিনি। চিঠির বিষয়টি জানাজানি হলে চাপের মুখে পড়ে এনসিটিবি।
পরিস্থিতি সামাল দিতে এনসিটিবি কর্মকর্তাদের পরামর্শে রাতে আবার শিক্ষা উপদেষ্টা বরাবর চিঠি লেখেন মুদ্রণ সমিতির এ নেতা। তাতে ‘বিভ্রান্তি ছড়ানোয়’ ও ‘জাতীয় স্বার্থবিরোধী কাজ’ করায় জাতির কাছে ক্ষমা চান তিনি।
যদিও বই ছাপাতে বিলম্বের বিষয়টি নিয়ে বাংলাদেশ মুদ্রণ শিল্প সমিতির নেতাদের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করেও তাদের মন্তব্য পাওয়া যায়নি।
এ ব্যাপারে নাম প্রকাশ না করার শর্তে সমিতির এক সদস্য সময়ের আলোকে বলেন, এবার বিভিন্ন কারণে ছাপার কাজ দেরিতে শুরু হয়েছে। আবার কাগজের সংকটও আছে। তবে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির পাঠ্যবইয়ের ছাপার কাজ অনেক আগেই শেষ হয়ে গেছে। এখন তৃতীয় শ্রেণির পাঠ্যবই ছাপারও কাজ শেষ পর্যায়ে রয়েছে। আশা করি নির্দিষ্ট সময়েই বই ছাপার কাজ শেষ হবে। আবার অনেকে অভিযোগ করেছেন, নিয়মের বাইরে গিয়ে তাড়াতাড়ি বই ছেপে দিতে সরকার আমাদের চাপ দিচ্ছে সরকার।
অন্যদিকে মঙ্গলবার এক অফিস আদেশে বলা হয়েছে, ২০২৫ শিক্ষাবর্ষের পাঠ্যপুস্তক মুদ্রণ, বাঁধাই ও সরবরাহের নিমিত্তে মনিটরিং কার্যক্রম চলমান। এটি জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ কাজ বিধায় বোর্ডে কর্মরত সব কর্মকর্তা-কর্মচারীর (সেসিপ প্রকল্পসহ) নৈমিত্তিক ও সাপ্তাহিক ছুটি নির্দেশক্রমে বাতিল করা হলো।
এ ব্যাপারে এনসিটিবির চেয়ারম্যান প্রফেসর ড. একেএম রিয়াজুল হাসান সময়ের আলোকে বলেন, আমরা নিম্নমানের কাগজে পাঠ্যবই ছাপানোর সুযোগ দিচ্ছি না বলেই এবার বই পৌঁছে দিতে কিছুটা দেরি হচ্ছে। এর মধ্য কিছু প্রেস মালিকের মধ্যে একটা সিন্ডিকেট রয়েছে। তারা কাগজ সংকট, ডলার সমস্যাসহ নানা অজুহাত দাঁড় করানোর চেষ্টা করেছে। কিন্তু কোনো লাভ হবে না। আর আমরা যদি তাদের সেই সুযোগ দিতাম তা হলে ২৫ ডিসেম্বর মধ্যে স্কুলে স্কুলে বই পৌঁছে যেত।
তিনি বলেন, এবার বইয়ের কাগজের মান ও বাঁধাই অবশ্যই ভালো করার বিষয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের কঠোর নির্দেশ রয়েছে। সেই নির্দেশ প্রতিপালন করছে এনসিটিবি। আমরা আশা করছি, জানুয়ারি এক তারিখে প্রাথমিকসহ অন্য শ্রেণির বাংলা এবং ইংরেজি বই পৌঁছে দিতে পারব। তবে ২০ জানুয়ারির মধ্যে শিক্ষার্থীরা সব বই হাতে পাবে, এটি নিশ্চিত।