বুধবার, ০৯ এপ্রিল ২০২৫, ২৬ চৈত্র ১৪৩১
শিরোনাম

সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের জন্য যাকাত: একটি সামাজিক দায়িত্ব


  এ কে এম আজিজুর রহমান

প্রকাশ :  ১৮ মার্চ ২০২৫, ০২:০২ দুপুর

বাংলাদেশে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি সত্ত্বেও সামাজিক বৈষম্য ও দারিদ্র্য সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের জীবনকে মারাত্মকভাবে প্রভাবিত করছে। শহর ও গ্রামে বসবাসরত এসব শিশু শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। প্রাথমিক শিক্ষায় নথিভুক্তির হার ৯৮% হলেও মাধ্যমিক তা কমে ৬২% এ নেমে আসে (ইউনিসেফ, ২০২২)। দারিদ্র্য ও শিশুশ্রমের কারণে ১৭% শিশু প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করার আগেই স্কুল ছেড়ে দেয় (বিবিএস, ২০২১)। পুষ্টিহীনতাও একটি বড় সমস্যা: ৫ বছরের কম বয়সী ২৮% শিশু খর্বকায় এবং ১০% শিশু কৃশকায় (বাংলাদেশ ডেমোগ্রাফিক অ্যান্ড হেলথ সার্ভে ২০২২)। কোভিড-১৯ পরবর্তী সময়ে জাতীয় জরিপে দেখা গেছে, ৩৭% শিশু প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা থেকে ছিটকে পড়েছে, যাদের অধিকাংশই অতি দরিদ্র পরিবারের। এছাড়াও, কক্সবাজারে প্রায় ৫ লাখ রোহিঙ্গা শিশু শিক্ষা ও অন্যান্য মৌলিক সুবিধা থেকে বঞ্চিত।

বিশ্বব্যাংকের ২০২৩ প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশে অতি দারিদ্র্যের হার ১১.৩% (গ্রামীণ অঞ্চলে বেশি), যা প্রায় ১৭-২০ লাখ শিশুকে অতি দারিদ্র্যের মধ্যে রাখে। রংপুর, বরিশাল ও ময়মনসিংহে শিশু দারিদ্রের হার সবচেয়ে বেশি। এই পরিস্থিতিতে, যাকাত একটি শক্তিশালী সামাজিক নিরাপত্তা বলয় হিসেবে কাজ করতে পারে।

ইসলামে যাকাত একটি গুরুত্বপূর্ণ আর্থিক ইবাদত যা সম্পদশালী মুসলমানদের উপর ফরজ করা হয়েছে। যাকাতের মাধ্যমে ধনী ব্যক্তিরা তাদের সম্পদের একটি নির্দিষ্ট অংশ গরীব ও অসহায় মানুষের মাঝে বিতরণ করে। কোরআনে যাকাতের প্রাপক হিসেবে ৮টি শ্রেণি উল্লেখ করা হয়েছে (সূরা তওবা ৯:৬০)। এর মধ্যে গরীব ও মিসকিন (অতি দরিদ্র) শ্রেণির মধ্যে সুবিধাবঞ্চিত শিশুরাও অর্ন্তভুক্ত। এছাড়াও যাকাতের অর্থ অনাথ ও অসহায় শিশুদের কল্যাণে ব্যয় করা যায়। যা তাদেরকে শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও পুষ্টির চাহিদা পূরণই করবে না, বরং তাদেরকে একটি সুন্দর ভবিষ্যত গড়ে তুলতেও সাহায্য করবে।

সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের জীবনমান উন্নয়নে যাকাত একটি শক্তিশালী হাতিয়ার হতে পারে, যাকাতের সঠিক ব্যবহারের মাধ্যমে আমরা একটি বৈষম্যহীন ও সুস্থ সমাজ গড়ে তুলতে পারি, যেখানে প্রতিটি শিশু তার মৌলিক অধিকার ভোগ করতে সক্ষম হবে।

আমরা শিশুদের জন্য যাকাত দিয়ে যেভাবে সহযোগিতা করতে পারি, তা কিছুটা আলোকপাত করা হলো:

১. অর্থনৈতিক সহায়তা: সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের মৌলিক চাহিদা পূরণে যাকাত অর্থনৈতিক সহায়তা প্রদান করে। এর মাধ্যমে তাদের খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও চিকিৎসার ব্যবস্থা করা যায়।

২. শিক্ষার সুযোগ: যাকাতের অর্থ ব্যবহার করে সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের শিক্ষার ব্যবস্থা করা যায়। ইসলামে জ্ঞানার্জনকে অত্যন্ত গুরুত্ব দেয়া হয়েছে, এবং যাকাতের মাধ্যমে শিশুদের শিক্ষার পথ সুগম করা যায়।

৩. স্বাস্থ্য ও সুরক্ষা: দরিদ্র শিশুদের চিকিৎসা সেবা নিশ্চিত করতে যাকাতের অর্থ ব্যবহার করা যায়। এর মাধ্যমে দূরারোগ্য ব্যধিতে আক্রান্ত শিশুদের পরিবার কিছুটা হলেও আর্থিক সহযোগিতা পেয়ে থাকে।

৪. সামাজিক নিরাপত্তা: যাকাতের মাধ্যমে সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যায়। এটি তাদেরকে অপরাধ ও শোষণের হাত থেকে রক্ষা করতে সাহায্য করে।

৫. আত্মসন্মানবৃদ্ধি: যাকাত ইসলাম ধর্মে যাকাত প্রদান কোন দয়া বা করুণা নয়, বরং এটি একটি অপরিহার্য গুরুতপূর্ণ ইবাদত। সুষ্ঠ যাকাত ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে যাকাতের অর্থ যথাযথ প্রক্রিয়ায় সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের কল্যাণে সরবরাহ করতে পারলে শিশুরা দরিদ্রের কষাঘাত থেকে মুক্ত করে তাদের আত্মসম্মান ও আত্মবিশ্বাস নিয়ে সফল মানুষ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করবে বলে আমাদের বিশ্বাস।

যাকাতের মাধ্যমে সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের জীবন মান উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখা সম্ভব। এটি শুধু তাদের মৌলিক চাহিদা পূরণই নয়, বরং তাদেরকে সমাজের মূলধারায় ফিরিয়ে এনে একটি সুন্দর ভবিষ্যত গড়ে শিশুটিকে জাতীয় সম্পদে পরিণত করতে সহায়তা করবে। এই শিশুরা আমাদেরই সমাজের অংশ, কেউ বা আমাদের পরম আত্মত্মীয়। আসুন সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকে শিশুদের কল্যাণে আমাদের যাকাতের কিছু অংশ উৎসর্গ করি।

এ কে এম আজিজুর রহমান
শিশু উন্নয়ন কর্মী ও সদস্য, পূর্বধলা প্রেস ক্লাব

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত