ঢাকা, মঙ্গলবার, ০৮ অক্টোবর ২০২৪, ২২ আশ্বিন ১৪৩১
শিরোনাম

গারো পাহাড়ে এবার কফি চাষ শুরু


  রফিক মজিদ, শেরপুর প্রতিনিধি

প্রকাশ :  ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১২:৩৮ দুপুর

শেরপুরের নালিতাবাড়ী উপজেলার সীমান্তবর্তী গারো পাহাড়ি এলাকায় কফি চাষের উজ্জল সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। ফলে পাহাড়ে এই  ফসলের নতুন দিগন্তে নতুন স্বপ্ন দেখাচ্ছে কৃষকদের। এখানকার কৃষিতে এ ফসল যেন এক নতুন অতিথি হিসেবে এসেছে। তাই এই অঞ্চলে কফি চাষ নিয়ে এখন ব্যাপক আশাবাদী কৃষকরা। কাঙ্খিত ফলন ও বাণিজ্যিক পথ সুগম হলে সম্ভাবনার নতুন দুয়ার খুলে যাবে বলে এলাকার কফি চাষীরা জানান। 

উদ্যোগক্তা কৃষিবিদ সাজ্জাদ হোসেন তুলিপ নামের এক ব্যক্তি বিনামুল্যে কৃষকদের মাঝে কফির চারা বিতরণ করছেন। প্রতিদিন জেলার বিভিন্ন এলাকা থেকে কৃষকরা এসে কফি গাছের চারা নিয়ে যাচ্ছেন। এতে লাভের আশায় কৃষকরাও দারুনভাবে খুশি হচ্ছেন।

উপজেলা কৃষি অফিস, উদ্যোক্তা ও চাষীরা জানান, পৃথিবীতে ৬০ প্রজাতির কফি থাকলেও বাণিজ্যিকভাবে দুই রকমের কফির চাষ রয়েছে। এই এলাকায় বাণিজ্যিকভাবে চাষের জন্য এরাবিকা ও রোবাস্টা জাতের কফি চাষ শুরু হয়েছে। রোবাস্টা জাতের কফি বাংলাদেশের আবহাওয়ায় বেশি উপযোগী। যে কারনে নালিতাবাড়ী উপজেলা পাহাড়ি অঞ্চল আবহাওয়ায় এর সম্প্রসারণ করা সম্ভব হবে। কফির চারাগুলো দেখতে কিছুটা দেবদারু চারার মতো। 

মার্চ থেকে এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি সময়ের মধ্যে প্রতিটি পরিপক্ব গাছে ফুল ধরা শুরু হয়। মে থেকে জুন মাসের মধ্যে ফুল থেকে গুটি গুটি ফলে পরিণত হয়। আগস্ট মাসের মাঝামাঝি সময় থেকে সেপ্টেম্বর মাসের মধ্যে ফল পরিপক্বতা লাভ করে। পরে এগুলো রোদে শুকিয়ে নিতে হয়। বাজারজাত ও কফি পান করার জন্য উপযোগী করতে মেশিনের মাধ্যমে কফিবীজ গুঁড়া করে নিতে হয়। 

আবার কফির বীজ থেকে চারা উৎপাদন করা যায়। ফলন ভালো হলে এবং আবহাওয়া অনুকূলে থাকলে গাছ প্রতি ৫/৭ কেজি কফি পাওয়া সম্ভব বলে জানা গেছে। প্রতি কেজি কফির দাম ৮০ থেকে ১০০ টাকা। প্রতি একরে ২৫০/৩০০ টি গাছ লাগানো যায়। সেই হিসেবে বছরে ২০০ কফি গাছ থেকে ১ হাজার ৬০০ কেজি পর্যন্ত কফি ফলন পাওয়া যায়। যার ন্যূনতম বাজারমূল্য ১ লাখ ৬০ হাজার টাকা। 

বর্তমানে এই কফি চাষে নালিতাবাড়ী উপজেলার কৃষকদের সার্বিক সহযোগিতা করছেন কৃষিবিদ সাজ্জাদ হোসেন তুলিপ। তিনি একটি বেসরকারী কোম্পানীতে চাকুরীর সুবাদে বান্দরবন জেলায় প্রজেক্ট ইনচার্জ হিসেবে কর্মরত ছিলেন। এমতাবস্থায় রুমা উপজেলার ডার্জিলিং পাড়ায় কফি চাষ প্রথমে তার নজরে আসে। সেখান থেকেই কফিচাষ নিয়ে গবেষনা শুরু করেন কৃষিবিদ সাজ্জাদ হোসেন তুলিপ। 

২০২১ সালে লাল লিয়াং বং এর বাগান হতে ৫ কেজি কফি কিনে চারা উৎপাদন করেন। সেই চারা পরীক্ষামুলকভাবে পাশ্ববর্তী হালুয়াঘাট, ঝিনাইগাতী ও নালিতাবাড়ী উপজেলায় এবং বান্দরবানের কিছু চাষীদের মাঝে বিতরন করেন। 

এরপর আবার ২০২২ সালে আরো কিছু কফির চারা বিতরন করেন। সেই চারাগুলো থেকে পরিপুর্ণভাবে এখন ফল দেওয়া শুরু করেছে। ওইসব কফি সংগ্রহ করে অল্প কিছু ফল নিজস্ব মেশিনে রোস্টিং করে বাজারজাত করা হচ্ছে। 

উদ্যোগক্তা কৃষিবিদ সাজ্জাদ হোসেন তুলিপ জানান, বাংলাদেশে কফি চাষ সম্প্রসারণ ও বানিজ্যিককরনের লক্ষে এই অ লে গারো পাহাড়ে প্রচুর অব্যবহৃত জমিকে চাষের আওতায় আনতে আগামী দুই বছরে প্রায় দুই লাখ চারা বিনামুল্যে দেওয়ার পরিকল্পনার অংশ হিসেবে এই পর্যন্ত ৬৩ জন চাষীর মাঝে প্রায় ২০ হাজার চারা বিনামুল্যে বিতরণ করেছেন। এই চারাগুলো আগামী দুই বছরের মাথায় ফল দেওয়া শুরু করবে। এছাড়া তিনি কফি চাষীদেরকে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে চারা রোপন ও পরিচর্যা বিষয়ে অবহিত করছেন। একই সাথে সহায়ক হিসেবে একটি করে বই দিচ্ছেন। 

তিনি আরো জানান, কফি চাষে বাড়তি কোন জমি লাগে না। বাড়ীর যে কোন বাগানে সাথী ফসল হিসেবে ছায়াযুক্ত জায়গাতে কফি চাষ করে বাড়তি আয় করছেন চাষীরা। উৎপাদিত কফি বিক্রি করার জন্য কৃষকদের কোথাও যেতে হচ্ছে না। তিনি নিজেই ন্যায্য মূল্যে কফি কিনে নিচ্ছেন। এতে কৃষকরা বাজারজাতকরন ও সঠিক দাম পেয়ে চাষীরা খুশি। তিনি আশা প্রকাশ করে বলেন দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশেও এই কফি রপ্তানী করবেন। 

কেন বিনামুল্যে কফির চারা বিতরন করেন এমন প্রশ্নে উদ্যোগক্তা কৃষিবিদ সাজ্জাদ হোসেন তুলিপ বলেন, নতুন ফসল হিসেবে কৃষকরা ঝুঁকি নিতে চান না। তাই তিনি নিজ উদ্যোগে চাষীদেরকে প্রশিক্ষণ দিয়ে বিনামুল্যে চারা বিতরন করছেন। এই চারাগাছ থেকে যখন কফি উৎপাদন শুরু হবে তখন তিনি কৃষকের কাছ থেকে ন্যায্য মুল্যে কাফ ক্রয় করে বাজারজাত করবেন। 

উপজেলার বিন্নিবাড়ী গ্রামের চাষী বুলবুল আহাম্মেদ বলেন, আমি দুইশত চারা নিয়েছি। আমার একটি লিচু ফলের বাগান আছে সেই বাগানের ছায়ায় এই কফি গাছের চারা রোপন করবো। 

রামচন্দ্রকুড়া গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা জালাল উদ্দিন বলেন, দুই বছর আগে আমি ৫৪ টা চারা লাগাইছিলাম। এ বছর ৫০ টা গাছে ফল ধরেছে। আমি আরো কফি চারা লাগানোর জন্য প্রস্ততি নিচ্ছি।

পাশ্ববর্তী হালুয়াঘাট উপজেলার কড়ইতলি গ্রামের কৃষক মনির হোসেন বলেন, অ্যারাবিকা ও রোবাস্টা জাতের চারশত কফির চারা রোপণ করেছি। এবছর প্রায় ২৫০ টি গাছে কফি ফল এসেছে। আশা করছি প্রতিটি গাছ থেকে দুই থেকে তিন কেজি কফি বিক্রি করতে পারবো।

নালিতাবাড়ী উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. আব্দুল ওয়াদুদ বলেন, উপজেলার গারো পাহাড়ি এলাকার মাটিতে অম্লত্ব ও উর্বরতা শক্তি কফি চাষের জন্য বেশ উপযোগী। বৃষ্টিপাত ও মাটির গঠন বিন্যাস মিলে এই উপজেলায় কফি চাষের উজ্জ্বল সম্ভাবনা রয়েছে। উদ্যোক্তার সাথেও আমাদের যোগাযোগ আছে। আমরা এ ব্যাপারে কৃষকদের সার্বিক পরামর্শ ও সহযোগিতা করে যাচ্ছি।

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত