ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ০৯ মে ২০২৪, ২৬ বৈশাখ ১৪৩১
শিরোনাম

রোজা রাখার ১১টি স্বাস্থ্য উপকারিতা!

  নিউজ ডেস্ক

প্রকাশ :  ১২ মার্চ ২০২৪, ০২:০৫ দুপুর

পবিত্র রমজান মাসে আমরা আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টি লাভের আশায় সিয়াম পালনের উদ্দেশ্যে দীর্ঘ সময় খাবার এবং পানাহার থেকে বিরত থাকি। লম্বা সময় না খেয়ে থাকার কারণে আমাদের শারীরবিত্তীক প্রক্রিয়ার বিভিন্ন পরিবর্তন ঘটে থাকে। আসুন জেনে নেয়া যাক রোজায় আমাদের আভ্যন্তরীণ শরীরে কি ধরনের পরিবর্তন ঘটে থাকে এবং এর স্বাস্থ্য উপকারিতা গুলো। 

 

রোজায় আমাদের শারীরবৃত্তীয় যে পরিবর্তন ঘটে

আমরা সাধারণত রোজা ছাড়া অন্যান্য সময় ৭-৮ ঘণ্টা পর পর খাবার খেয়ে থাকি এবং আমাদের খাবারের মধ্যে যে কার্বোহাইড্রেট জাতীয় খাবার থাকে সেখান থেকে গ্লুকোজ পাওয়া যায়। আর কার্বোহাইড্রেট খাবার থেকে প্রাপ্ত এই গ্লুকোজকে আমাদের শরীর শক্তির প্রাথমিক উৎস হিসেবে ব্যবহার করে বিভিন্ন শারীরবৃত্তীয় কার্যাবলী সম্পাদন করে থাকে। গ্লুকোজ মূলত লিভার এবং মাংশপেশীতে জমা থাকে এবং শরীরের প্রয়োজনে আমাদের রক্ত প্রবাহে নিঃসৃত হয়।  

কিন্তু যখন নাকি রমজান মাসে আমরা দীর্ঘ সময় খাবার এবং পানাহার থেকে বিরত থাকি তখন পুরো প্রক্রিয়াতে কিছুতা ভিন্নতা আসে। সাধারণত ৮ ঘণ্টা পর্যন্ত লিভার থেকে সংরক্ষিত গ্লুকোজ আমাদের শারীরিক প্রয়োজনে নিঃসৃত হয়। এরপরে লিভারে আর গ্লুকোজ সংরক্ষিত না থাকায় শরীরে উপস্থিত ফ্যাট বা চর্বিকে ব্যবহার করে আমাদের শরীর নিজস্ব প্রক্রিয়ার গ্লুকোজ তৈরি করে।

এই পর্যায়ে শরীরে আরও বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটে থাকে। আমাদের শরীর এ অবস্থায় রক্ত প্রবাহে কোলেস্টেরল এবং ইউরিক এসিড নিঃসরণ করে যার মাধ্যমে শরীরের ক্ষতিকর পদার্থ শরীর থেকে বের হয়ে যায়।          

এছাড়া অনেক্ষন ধরে খাবার না খাওয়ার কারণে আমাদের পরিপাকতন্ত্রের বিশ্রাম মেলে, পাকস্থলি বা অন্ত্র পরিষ্কার হয় এবং তার স্তরগুলো শক্তিশালী হয়।

দীর্ঘসময় না খেয়ে থাকলে আমাদের শরীরে অটোফ্যাজি নামে একটি প্রক্রিয়া উদ্দীপিত হয়, যেখানে আমাদের শরীরের ক্ষতিগ্রস্থ কোষগুলি নিজেই নিজেদের অপসারণ করতে সাহায্য করে।

আবার দীর্ঘসময় পানাহার থেকে বিরত থাকায় ডিহাইড্রেশন বা পানিস্বল্পতা দেখা দেয়। এই পানিস্বল্পতার জন্য সাধারণত মাথা ব্যাথা, দূর্বল লাগা এবং অমনযোগীতা তৈরি হয়। এ কারণে রমজান মাসে ইফতার থেকে সেহরি পর্যন্ত পর্যাপ্ত পরিমান পানি পান করা জরুরি। এই পানিস্বল্পতা কিছুটা কমানোর জন্য আমাদের কিডনি তার ছাঁকন প্রক্রিয়া কমিয়ে প্রস্রাবের পরিমাণ হ্রাস করে যতটা সম্ভব পানি ধরে রাখার চেষ্টা করে। 

এভাবে রোজা রাখার কারণে আমাদের শরীরে যে শারীরবৃত্তীয় পরিবর্তনগুলো ঘটে থাকে সেগুলো আসলে আমাদের সার্বিক স্বাস্থ্যের জন্য বেশ কিছু উপকারিতা নিয়ে আসে। ধর্মীয় বিবেচনায় রোজা যেমন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি ফরয ইবাদত তেমনি রোজা রাখার মধ্য দিয়ে পাওয়া যায় অনেক ধরনের স্বাস্থ্য উপকারিতা। স্বাস্থ্যকর রক্তকনিকার পুনর্জন্ম থেকে শুরু করে হার্টের কার্যকারিতার উন্নতি সাধন, পরিপাকতন্ত্রের কর্মক্ষমতা, মস্তিস্কের বিকাশ সাধন, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি সহ আরও অনেক ধরনের স্বাস্থ্য উপকারিতা পাওয়া যায়। আসুন সংক্ষিপ্ত আকারে রোজা রাখার কারণে বিভিন্ন স্বাস্থ্য উপকারিতা সম্পর্কে জেনে নেই।   

১। রোজা রাখলে শরীরের ক্ষতিকর পদার্থ বের হয়ে যায়       

পবিত্র রমজান মাসে আমরা টানা ৩০ দিন লম্বা সময় ধরে রোজা রাখি। রোজায় দিনের বেশীরভাগ সময় আমরা খাবার গ্রহণ না করার কারণে আমাদের শরীরের লিভার, পাকস্থলী এবং অন্যান্য অঙ্গ বিশ্রাম পায়। আর যেহেতু আমাদের শরীর তার নিজস্ব প্রক্রিয়ায় বিভিন্ন কাজ সম্পাদন করে থাকে তাই এসময় আমাদের শরীরে যে টক্সিন বা বিষাক্ত পদার্থ গুলো জমা হয়ে ছিল সেগুলো শারীরিক ক্রিয়াকলাপের মাধ্যমে শরীর থেকে বের করে দেয়। এতে করে আমাদের অঙ্গ প্রতঙ্গের কার্যকারিতা বৃদ্ধি পায়, পরিপাকতন্ত্র পরিস্কার হয়ে যায় এবং রক্ত সঞ্চালনের উন্নতি ঘটে।

২। রোজায় হজমশক্তি বৃদ্ধি পায়

লম্বা সময় খাবার থেকে বিরত থাকার কারণে আমাদের পরিপাকতন্ত্র বিশ্রাম পায়, লিভার থেকে এনজাইম নিঃসরণ হয় যেগুলো শরীরের চর্বি এবং কোলেস্টেরলকে ভেঙ্গে বাইল এসিডে  রুপান্তরিত করে যেটা কিনা পরিশেষে হজমশক্তি বৃদ্ধি করে। এছাড়া যে খাবার গুলো আগে হজম হয়নি সেগুলো হজম হয়ে পাকস্থলী ও অন্ত্র পরিস্কার হয়। এছাড়া রোজা টানা রাখার কারণে ক্ষুধা কমে যায় এবং শরীরে ক্ষুধা সৃষ্টির হরমোন কম নিঃসৃত হয় যার ফলে অল্প খেলেই ক্ষুধা মিটে যায়। এই পরিবর্তনও পরিপাকতন্ত্র এবং হজমের জন্য ভালো।        

৩। ওজন হ্রাস করতে সাহায্য করে 

আমরা যদি দীর্ঘ সময় রোজা রাখি এবং স্বাস্থ্যকর খাবার পরিমিত ভাবে খাই তাহলে ওজন কমানো খুব সহজ হয়ে যায়। কেননা লম্বা সময় না খেয়ে থাকার কারণে আমাদের শরীর বিভিন্ন শারীরবৃত্তীয় কাজ সাধনের জন্য শরীরে উপস্থিত চর্বিকে ব্যবহার করে বিভিন্ন কাজ সম্পাদন করে থাকে। যেহেতু এ প্রক্রিয়ার শরীরে জমা চর্বি ব্যবহিত হয়ে যায় এতে করে ওজন হ্রাস পায়।      

৪। রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে

আমাদের শরীরের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থাপনার মধ্যে শ্বেত রক্তকনিকা অন্তর্ভুক্ত এবং রোজা রাখার মাধ্যমে নতুন শ্বেত রক্তকনিকার উৎপত্তির মাধ্যমে আরও বেশি কার্যকরী হয় এবং স্বাস্থ্য সম্মত ও বলিষ্ঠ রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করে। এছাড়া দীর্ঘ সময় খাবার বিরতির পর আমরা যখন ইফতার করি তখন আমাদের শরীরে “স্টিম সেল” নামক কোষ পুনরুদ্ধার হয় যেখানে লাল এবং শ্বেত রক্ত কনিকা ও প্লাটিলেট থাকে যার কারণেও আমাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়।    

৫। রক্তচাপ কমায় 

দিনের লম্বা সময় খাবার না খাওয়ার কারণে শরীর লবণ গ্রহণ করে না এবং সারাদিনে ইউরিন বা মুত্রের সাথে লবণ বের হয়ে যায় যার ফলে রোজা রাখার কারণে রক্তচাপ কমে।  

৬। শরীরের চর্বি কমাতে সাহায্য করে

রোজা রাখার কারণে আমাদের শরীরে “হিউম্যান গ্রোথ হরমোন” নামে একটি হরমোন উৎপন্ন হয় যেটা শরীরের চর্বি গলাতে কার্যকরী ভূমিকা পালন করে।  

৭। হৃদযন্ত্রের কার্যকারিতা বৃদ্ধি করে

রোজা রাখার কারণে শরীরে খারাপ কোলেস্টেরলের পরিমান হ্রাস পায়, রক্তচাপ নিয়ন্ত্রিত হয় ফলে হৃদযন্ত্রের কার্যকারিতা বৃদ্ধি পায় এবং উন্নতি সাধন হয়।  

৮। মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নতি সাধন

রোজা রাখার কারণে ক্যালরি, চিনি এবং লবণ কম পরিমানে খাওয়া হয় যার কারণে আমাদের মানসিক স্বাস্থ্য শক্তিশালী হয়, স্ট্রেস কমে এবং মানসিক সচ্ছতা পাওয়া যায়।    

৯। ব্লাড সুগার নিয়ন্ত্রণ 

রোজা এবং সঠিক খাদ্যাভ্যাস রক্তের সুগারকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে যার কারণে অনেক গবেষণায় দেখা গেছে টাইপ-২ ডায়াবেটিক এর ক্ষেত্রে ভালো ফলাফল পাওয়া যায়।   

১০। বার্ধক্য প্রক্রিয়াকে ধীর করে

রোজা রাখার কারণে শরীরে বেশ কিছু প্রক্রিয়া হয়ে থাকে যেমন অটোফ্যাজি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে আমাদের শরীরের ক্ষতিগ্রস্থ কোষগুলি নিজেই নিজেদের অপসারণ করে। এছাড়া শরীরে জমা থাকা ক্ষতিকর পদার্থ শারীরিক প্রক্রিয়ায় শরীর থেকে বের হয়ে যায়। পরিপাকতন্ত্র, লিভার, হার্ট এবং অন্যান্য অঙ্গের কার্যকারিতা বৃদ্ধি পায়, রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থাপনার উন্নতি সাধন হয়। সব মিলিয়ে শারীরিক কর্মক্ষমতা বৃদ্ধি পায় এবং বার্ধক্য প্রক্রিয়া ধীর হবার সম্ভাবনা থাকে।    

১১। মস্তিষ্কের কার্যকারিতা বৃদ্ধি পায় 

রোজা রাখা অবস্থায় রক্তে “এনডোরফিনস” নামক হরমোন এর পরিমান বৃদ্ধি পায় যেটা নাকি একটা প্রশান্তির অনুভূতি দেয়। এর ফলে মস্তিষ্কের কার্যকারিতাও বৃদ্ধি পায়।   

 

তবে এতসব স্বাস্থ্য উপকারিতা নিশ্চিত করার জন্য আমাদের কিন্তু স্বাস্থ্যকর ইফতার এবং সেহেরী নিশ্চিত করা লাগবে। অস্বাস্থ্যকর এবং বেশি করে মসলা, তেল এবং লবণ ব্যবহার করা ইফতার কিন্তু আমাদের জন্য সুস্বাস্থ্যের বদলে অসুস্থতা নিয়ে আসবে যেটা আমরা অবশ্যই এই করোনাভাইরাসের ভয়ঙ্কর পরিস্থিতিতে চাই না। 

আর পরিশেষে আরেকটি কথা না বললেই নয়। আমাদের রোজা রাখার মূল উদ্দেশ্য কিন্তু হতে হবে আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টি আর তার পাশাপাশি যে স্বাস্থ্য উপকারিতা আমরা পাচ্ছি সেটা হচ্ছে প্রত্যাশার অতিরিক্ত।

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত