পিকাসোর নীল অধ্যায়
আরবান ডেস্ক
প্রকাশ : ২৯ অক্টোবর ২০২৪, ১২:০২ দুপুর
পাবলো দিয়াগোমে হোসে ফ্রান্সিসকো দ্য পলা হুয়ান নেপমুসেনো মারিয়া দ্য লুস রেমেদিওস ক্রিসপিয়ানো দ্য লা সান্তিসিমা ত্রিনিদাদ রুইজ ই পিকাসো। দীর্ঘ নাম থেকে প্রথম ও শেষ শব্দ নিয়ে আত্মপ্রকাশ করলেন পাবলো পিকাসো। এই পৃথিবী যাদের একবারই পায়, পায় নাকো আর; যদি জীবনানন্দের কাছ থেকে ধার করে বলতে হয়।
পিকাসো স্পেনের মালাগায় ১৮৮১ সালের ২৩ অক্টোবর পৃথিবীর আলোয় প্রথম চোখ মেলেছিলেন, পৃথিবীর হাওয়ায় প্রথম শ্বাস নিয়েছিলেন। ১৪৩তম জন্মদিন অতিক্রান্ত হলো এ বছর। অথচ পিকাসো যেন এখনও ‘সেদিনের স্মৃতি’। মূলত পিকাসোর ব্লু পিরিয়ড, পিকাসোর মাতৃভাষা স্প্যানিশে যা পিরিয়োদো আজুল, বাংলায় নীল অধ্যায়ের কাছে আজকের এই লেখা সমর্পিত। ১৯০১ থেকে ১৯০৪ সাল পর্যন্ত সময়কে পিকাসোর নীল অধ্যায়ের অন্তর্গত ধরা হয়; মূলত। তাঁর প্রথম যৌবনের সবচেয়ে কাছের বন্ধু কার্লেস ক্যাসাজেমাস অপমৃত্যুর পর প্রথম এই শৈলী আত্মপ্রকাশ করে। এই নীল অধ্যায়ের পেছনে যে প্রেমজ ইতিহাস রয়েছে, তা আমাদের অনেকেরই জানা। তবু একটু পুনরাবৃত্তি, ইতিহাসের বর্ণিলতা বিচারে, হয়তো বাহুল্য হবে না।
১৮ বছর বয়সে পিকাসোর পরিচয় হয় চিত্রশিল্পী ও কবি কার্লেস ক্যাসাজেমাসের সঙ্গে। পিকাসোর তেরো মাসের বড় ক্যাসাজেমাস; জন্ম ২৭ সেপ্টেম্বর ১৮৮০। একসঙ্গে দুজন স্পেন ঘুরেছেন, পরে ফ্রান্সে এসেছেন। প্যারিসে একটা স্টুডিও ভাড়া করে থাকতেন দুই বন্ধু। ছবি আঁকতেন। তাদের দুজনের কাছে ছবি আঁকার মডেল দিতে আসতেন জার্মেইন গার্গালো ফ্লোরেন্তিন পিশট। জার্মেইনকে মনে মনে ভালোবাসতেন ক্যাসাজেমাস। গত সহস্রাব্দের কথা হলেও, এমন দুর্মদ ভালোবাসা চিরনবায়িত। আবেগের ঝড়, তারুণ্যের রাগানুরাগ, আর পরিবর্তিত বিশ্বের রেনেসাঁক্রান্ত ঢেউয়ের শেষদিককার দোলা– সব মিলিয়ে মানুষের বুকের ভেতর; বলা ভালো শিল্পীর বুকের ভেতর; একটা উন্মাদীয় আবহ তৈরি করেছিল।
ধ্রুপদি শিল্পী-সাহিত্যিকদের নিযুত বিস্ফোরণের কাল ওটা। যে বিস্ফোরণের ছটা আজও বর্তমান। যে অপমৃত্যু পিকাসোর ব্লু পিরিয়ডের জন্ম দিয়েছিল, সেই বিয়োগান্তকতার গভীরতা বুঝতে এটুকু ভূমিকা সঙ্গী করে, এবার আসছি মূল গল্পরেখায়। ক্যাসাজেমাস ভালোবাসলেন জার্মেইনকে। বন্ধুর আগ্রহ দেখে পিকাসো সঙ্গ নিলেন জার্মেইনের বান্ধবী লুইজি ওদেত্তে লেনোয়ার। হঠাৎ শম্পাহত ক্যাসাজেমাস। তুরীয় এক মুহূর্তে আবিষ্কার করলেন, তিনি অবয়বে পুরুষ বটে, কিন্তু পৌরুষবিহীন। তাহলে কি জার্মেইনকে ভালোবাসা ব্যর্থ হয়ে যাবে? ভালোবাসার নারীর সঙ্গে শারীরিকভাবে মিলিত হওয়া যদিও শেষকথা নয়, তবু শ্লেষকথাও নয়। কার্লেস ক্যাসাজেমাসকে ঘন হতাশা পেয়ে বসল। ভালোবাসলেও তা ব্যক্ত করেননি ক্যাসাজেমাস। এর ভেতর নিজ পুরুষত্বহীনতা আবিষ্কার করলেন। মানসিকভাবে পর্যদুস্ত। এ অবস্থায় জার্মেইনকে প্রেম নিবেদন না করলেও পারতেন। কিন্তু সিদ্ধান্ত বিচারের মতো অবস্থায় ছিলেন না তিনি। জার্মেইন যখন তাঁকে ‘না’ জানিয়ে দিলেন, তখন ক্যাসাজেমাস ক্ষেপে উঠলেন ট্যান্টালাসের মতো। পিস্তল ছিল, গুলি করে বসলেন জার্মেইনকে। জার্মেইনের গায়ে গুলি লাগল না, কিন্তু তিনি মেঝেতে পড়ে গেলেন। পরের গুলিটা ক্যাসাজেমাস করলেন নিজ মাথায়। সেদিন ১৭ ফেব্রুয়ারি ১৯০১। হাসপাতালে মারা গেলেন ক্যাসাজেমাস। পিকাসো তখন প্যারিসে নেই।
প্যারিসে ফিরে এলেন পিকাসো। প্রিয় বন্ধু মৃত। গভীর হতাশা আক্রান্ত করল তাঁকে। পৃথিবী পেল পিকাসোর ব্লু পিরিয়ড। সেই যে জার্মেইন, তিনি বাকি জীবনের অনেকটা সময় পিকাসোর বন্ধু হয়েছিলেন। পিকাসোর অসংখ্য ছবির মডেল তিনি। আফ্রিকা সিরিজের ছবিগুলোর কথা আলাদাভাবে উল্লেখ করা যায়।
স্পেন, ফ্রান্স শুধু নয়, গোটা ইউরোপে বিষণ্নতা, বিপন্নতা, অসহায়ত্ব, গাঢ়-গম্ভীর মেলানকোলির প্রতীকী রঙের নাম নীল। পিকাসো যাদের গুরু মানতেন; ভ্যান গগ, পল গঁগা, পল সেজান, দিয়েগো ভেলাসকুয়েজ, ফ্রান্সিসকো গয়া, অঁরি রুশো; তাদের ছবিতেও নীল রং বিষণ্নতা, একাকিত্বের একটা সাধারণ বিবৃতি প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছিল। পিকাসো তাতে প্রভাবিত হন। বন্ধুর মৃত্যু-পরবর্তী বাস্তবতায়, যু্দ্ধ-অন্তর্ঘাতসম্পন্ন ইউরোপের আবহে, ১৯০১ থেকে ১৯০৪– চারটি বছর নীলের একরঙাবহে একে একে অসংখ্য ছবি এঁকে যান। তাঁর আঁকা ব্লু পিরিয়ডের ছবিগুলো ভেতর অন্যতম হয়ে আছে দ্য ব্লু গিটারিস্ট, দ্য ট্র্যাজেডি, দ্য ব্লু রুম, ওম্যান উইথ ফোল্ডেড আর্মস, সেলেস্তিনা, আত্মপ্রতিকৃতি প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য।
দ্য ব্লু রুম ছবিটির দিকে আলাদা দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। ২০১৪ সালে দ্য ইনডিপেন্ডেন্ট পত্রিকায় একটি প্রতিবেদনে এ ছবি নিয়ে একটি চাঞ্চল্যকর সংবাদ প্রকাশিত হয়। ছবিতে স্নানরত এক শ্বেতাঙ্গিনী ও তার অনুপম ঘর দেখে অনুমান করার উপায় নেই এর নিচে গালে হাত ঠেকিয়ে বসে আছেন একজন প্রৌঢ়। দ্য ব্লু রুম ছবি থেকে ডিজিটালি রং অপসারণ করে দেখা গেছে দ্বিতীয় সেই ছবিটির উপস্থিতি। সম্ভবত ক্যানভাসে পিকাসো সেই ছবিটিই আগে এঁকেছিলেন। পরে তার ওপর নতুন দ্য ব্লু রুম ছবিটি আঁকেন; যা পিকাসোর নীল অধ্যায়ের একটি ঐতিহাসিক অনবদ্য ছবি হয়ে আছে।