গলা-পঁচা লাশ নিয়েই ছকু মিয়ার জীবন চলে

সিদ্দিক আলম দয়াল
প্রকাশ : ১৫ জানুয়ারী ২০২৫, ০৯:৩৭ রাত

পঁচা, গলা, ফাসিতে ঝুলন্ত, দুর্ঘটনায় নিহত ব্যক্তির লাশ ঘাড়ে নিয়ে সোজা ভ্যানে তুলে নিয়ে গন্তব্যের টানে। বিচিত্র পেশার মানুষ ছুকু মিয়া। গভীর রাতে পুলিশের ফোন পেলে একাই ভ্যান নিয়ে ছুটে যান। যেখানে ডাক পরে। তারপর মরা পঁচা গলা মানুষের দেহ এক টানে ঘাড়ে তুলে। লাশ ভ্যানে তুলে নিয়ে সোজা হাসপাতালের মর্গে। ঝুলন্ত আর গলিত লাশ নিয়ে নানা অভিজ্ঞতার কথা শোনালেন তিনি। বলেন পঁচা-গলা ও ফাঁসিতে ঝোলানো লাশ দেখে সবাই দুরে চলে যায় ভয় । আর আমি একাই তার সৎকার করি ।
লাশ টানা ছাড়া অন্য কাজ করতে পারে না ছকু মিয়া। বুকে সাহস আছে বলে এই পঁচা-গলা আর ফাঁসিতে ঝোলানো লাশ নিয়ে কারবার তার। এখন পেশা হিসাবে বেছে নিতে বাধ্য হয়েছে। চার থানা পলাশবাড়ি, সাঘাটা, ফুলছড়ি ও গাইবান্ধা সদর থানা এলাকায় কারো অপমৃত্যু হলেই ডাক পড়ে ছকু মিয়ার। লোকে তাকে লাশ টানা ছকু হিসাবে জানে ।
স্ত্রী রেখা বেগম বলেন, কোথাও পঁচা লাশ পড়ে আছে-খবর পেলেই পুলিশ গিয়ে হাজির হয় ছকুর বাড়িতে। নয়তো ফোনে কথা হয় তার সাথে । তারপর ভ্যান নিয়ে ছকু মিয়া হাজির লাশের পাশে। ছকু মিয়া বলেন, মরা মানুষের লাশের খুব গন্ধ হয়। তারপরেও বাধ্য হয়েই মরা পঁচা, গলিত, গলায় ফাঁস লাগানো, কবর থেকে গন্ধযুক্ত লাশ তোলার কাজ করতে হয়। এক সময়ে মরা, পঁচা, গলা, ঝুলন্ত মানুষের লাশ দেখে খুব ভয় হতো । কিন্তু এখন অভ্যাস হয়ে গেছে।
গাইবান্ধা শহর থেকে ৫ কিলোমিটার পশ্চিমে বল্লমঝাড় ইউনিয়নের ইসলামপুর গ্রাম। এই গ্রামের রাস্তার পাশে টিনের দোচালা ঘর ছকু মিয়ার। দেখতে বেশ উচু লম্বা। বেশ সোজা সাদা চেহারা। বাপের এক ছেলে সে। সংসারে অভাবের কারনে ছোট বেলায় স্কুলে যেতে পারেনি। জমিতেও কাজ করতে পারে না। বয়স যখন ১৪ কি ১৫ তখন বিয়ে করেন রেখা নামের এক নারীকে। তারপর অভাব আরও জেকে বসে তার উপর। অভাবের তাড়নায় খুজতে থাকেন কাজ। পরিচয় হয় থানা পুলিশের সাথে ।
তাদের পরামর্শে ৩৫ বছর আগে থেকে লাশ টানার কাজ জোটে তার কপালে। প্রথম প্রথম মরা মানুষ দেখলে ভয় লাগতো। কিন্তু এই পেশা ছেড়ে দিলে ভাত জুটবে কোথায় থেকে। এর মধ্যে এক ছেলে ফিরোজ ও মেয়ে শরিফার জন্ম হয় তার সংসারে। বউ সন্তান মিলে ৪ জনের সংসার ।
তিনি বলেন, মানুষের পঁচা লাশ দেখে আর ফাঁসিতে ঝুলে থাকা বিভৎস লাশ দেখে আশেপাশের লোকজন সবাই দুরে সরে যায়। অস্ত্রধারী পুলিশও । কিন্তু আমি একাই ফাঁসির ঝুলন্ত লাশ বুকে নিয়ে নিচে নামিয়ে আনি। অনেক সময় লাশের শরীরের পায়খানা প্রশ্রাব তার গায়ে লাগে। কিন্তু কি আর করা? মাটিতে পড়ে থাকা কয়েকদিনের পঁচা লাশ দুই হাত দিয়ে তোলেন, তারপর তার ভ্যানে তুলে সোজা পুলিশের কথা মতো মর্গে।
ঝুলন্ত লাশ মাটিতে নামিয়ে মর্গে পৌঁছে দেয়া এবং তারপর ঠিকানা মতো পৌঁছে দিলে তাকে কেউ দেয় ৩ থেকে ৪ হাজার টাকা। আর কবর অথবা মাটি থেকে পঁচা গলিত লাশ তুলতে দেয় ৪ হাজার টাকা। আর অল্প সময়ের মরা মানুষের দেহ মর্গে নিয়ে যাওয়া ও ঠিকানা মতো পৌঁছে দিলে তাকে অন্তত ২ হাজার টাকা দিতে হয়।
এই কাজের জন্য মজুরী হিসাবে যা পায় তাতে তার পরিবারের মুখে দুই বেলা খাবার জোটে কোন মতো। লাশ নাই, তো কাজ নাই । লাশের অপেক্ষায় সারা মাস বসে থাকা লাশ ছাড়া উপায় থাকেনা । পুলিশের কাছে তার ফোন নম্বর থাকলেও সরকারী খাতায় তার নাম নেই। পঁচা গলা, কবর থেকে তুলে আনা আর ফাঁসিতে ঝুলন্ত লাশ তবু লাশ টানার কাজ করে পেটে ভাতের জন্য।
গাইবান্ধা সদর থানার ওসি শাহীনুর রহমান জানান, লাশ টানার কাজ কেউ করতে চায়না। ভয়ে মরা মানুষের থেকে দুরে দাড়িয়ে দেখতে থাকে মানুষ। আমি মনে করি উনি একটি মহৎ কাজের সাথে জড়িত। ফাঁসির বিভৎস লাশ থেকে শুরু করে, পড়ে থাকা পঁচা গলা একটি মরদেহ তিনি হাতে নিয়ে বহন করেন । এমন সাহস কার আছে? আর এ কাজও কেউ করতে চায়না। সে কারনে ছকু মিয়ার পাওনা আরও অনেক বেশি হওয়া উচিত।