চ্যালেঞ্জিং পেশা সাংবাদিকতায় গাইবান্ধায় আফরোজা লুনার এগিয়ে যাওয়া
আরবান ডেস্ক
প্রকাশ : ১০ জানুয়ারী ২০২৫, ০২:৫১ দুপুর
নাম তার আফরোজা লূনা। গাইবান্ধার সাহিত্য, সাংবাদিকতা, সংগীত, শিল্পকলা সহ প্রতিবাদী সকল কর্মকান্ডে যার ভুমিকা বেশ প্রশংসা অর্জন করেছেন। একুশে টেলিভিশনের গাইবান্ধা প্রতিনিধি ও স্থানীয় সাপ্তাহিক নারীশক্তি পত্রিকা সম্পাদনা করতে গিয়ে সাংবাদিকতায় তার পরিচিতি বৃদ্ধি পেয়েছে। গাইবান্ধায় নারী সাংবাদিকতায় তার অবস্থান বেশ প্রশংসিত। এক নামে চেনা সাংবাদিক আফরোজা লুনা শক্ত হাতে ক্যামেরায় ছবি তোলেন, ল্যাবলপে লেখেন খবর ও ভিডিও পাঠিয়ে দেন অফিসে। তারপর নিজেও সংসারের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। তিনি বলেন পুরুষ শ্বাসিত সমাজে নারী সাংবাদিকদের কতোটা চ্যালেঞ্জ নিয়ে কাজ করতে হয় তা আমিই প্রথম দেখিয়ে দিয়েছি গাইবান্ধায়। সাংবাদিকতায় অবদানের জন্য আফরোজা লুনা পেয়েছেন ভাষা সৈনিক কার্জন আলী সম্মাননা।
গাইবান্ধা শহরের মুন্সিপাড়া মসজিদের সামনে তার বাড়ি। পিতা মৃত গাজী মোহাম্মদ লাল মিয়ার দ্বীতিয় মেয়ে তিনি। তিন ভাই ও ২ বোনের মধ্যে আফরোজা লুনা চতুর্থ । মা নুরুন্নাহার বেগম গৃহিনী। স্কুল জীবন থেকেই লুনা বাস্তব সম্পর্কে ধারনা লাভ করেন । তখন থেকেই পড়ালেখা ও বাড়িতে মায়ের সাথে কাজের ফাঁকে লেখালেখি শুরু করেন। ছড়া, কবিতা, ছোট গল্প লিখে তা স্থানীয় লিটল ম্যাগাজিন গুলোতে দিতেন। ছাপাও হতো। সুরবানী সংগীত বিদ্যালয়ে ওস্তাদ সাফিমন্ডল ও নুরুল ইসলামের কাছে গানও শেখেন কিছু দিন। পড়ালেখার ফাকে তার বাড়ির আশে পাশের দরিদ্র শিক্ষার্থীদের পড়ালেখা শেখাতেন। কিন্তু টাকা পয়সা নিতেন না।
লুনা জানায়, সমাজে শুধু নিজেকে প্রতিষ্ঠা করতে হবে তা নয় । তাই নিজ দায়ীত্ব থেকেই শিশুদের পড়াতেন বিনা পয়সায়। মুন্সিপাড়া সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের গন্ডী পেড়িয়ে গাইবান্ধা আসাদুজ্জামান স্কুলে ভর্তি হন তিনি। তারপর ১৯৯০ সালে মেট্রিক পাশ করার পর গাইবান্ধা সরকারী কলেজে পা রাখেন। জাসদ ছাত্রলীগের রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। পড়ালেখা ,ছড়া কবিতা লেখায় একটু ভাটা পড়লেও লুনা অনেক স্বপ্ন দেখতে থাকেন। একদিন তাকে বড় হতে হবে। যেতে হবে অনেক দুর। মানুষের জন্য কিছু একটা করতে তার অবলম্বন প্রয়োজন। গাইবান্ধার বিভিন্ন নারী ও মানবাধিকার সংগঠনের সাথে যুক্ত হন। নারীদের অধিকার আদায়ে মানববন্ধন, রাস্তা, শহীদ মিনার ও শহরের গুরুত্বপুর্ণ স্থানে দাড়িয়ে মাইকে প্রতিবাদ জানাতেন। স্থানীয় রাজনীতিক, এনজিও কর্মী ও সাধারন মানুষের কাছে আলাদা পরিচিতি লাভ করেন। পিছিয়েপড়া দরিদ্র নারীদের অধিকার আদায়ে ছিলেন এবং এখনো আছে সামনের কাতারে। আফরোজা লুনা সংগঠক হিসাবে রয়েছেন বাংলাদেশ উদীচী শিল্পী গোষ্ঠি, দুর্নীতি দমন প্রতিরোধ কমিটি, স্বজন, সনাকে। বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমীতে আজীবন সদস্য।
১৯৯৪ সালের ২৪ শে মে তাকে বিয়ের পিড়িতে বসতে হয়। গাইবান্ধার সাংবাদিক সিদ্দিক আলম দয়ালের সাথে তিনি বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। এক মেয়ে তাসমিম সানজানা সৃষ্টি ও ছেলে তাওসিফ তামিম স্বচ্ছ সহ ২ সন্তানের জননী আফরোজা লুনা নিজেকে আরও বড় করে দেখতে চান। সাংবাদিক স্বামীর ছোটাছুটি, খবর সংগ্রহ, পাঠানোর ব্যস্ততা দেখে তার ভালো লাগতো। স্বামীর কাছে বিভিন্ন সময় আসতেন গাইবান্ধার রাজনীতিক, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, শিল্পি ছাড়াও বিভিন্ন পেশার নারী পুরুষরা। এক নামে পরিচিতি পাওয়া স্বামীর কাজ দেখে আফরোজা লুনা উৎসাহিত হতেন। তারও মনে হতো আমিও যদি সাংবাদিক হতে পারতাম। সে স্বপ্ন তার একদিন পুরন হলো। পুরুষের পাশাপাশি নিজেকে সাংবাদিক হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করা তার কাছে ছিলো এক বিরাট চ্যালেঞ্জ। চ্যালেঞ্জ গ্রহন করেই ২০১১ সালে টেলিভিশনের প্রথম নারী সাংবাদিক হিসাবে কাজ শুরু করেন একুশে টেলিভিশনে। পরে একুশে টেলিভিশনে গাইবান্ধা প্রতিনিধি হিসাবে আবেদন করে অন্যান্যদের সাথে প্রতিযোগিতা করেন তিনি । ইটিভি কর্তৃপক্ষ তার ফলাফল মুল্যায়ন করে গাইবান্ধা প্রতিনিধি হিসাবে নিয়োগ দেন আফরোজা লুনাকে।
নতুন করে যাত্রা শুরু হলো আফরোজা লুনার। এজন্য তাকে অনেক ইর্ষার মুখে পড়তে হয়। অন্যদের ইর্ষার কারনকে তিনি-এগিয়ে যাওয়ার পথ হিসাবে মনে এখনও করেন। খবরটি শুনে তার স্বামীর বড় ভাই আব্দুস সালাম তাকে একটি ভিডিও ক্যামেরা কিনে দিয়ে উৎসাহিত করেন । ক্যামেরা হাতে পেয়ে তার সাংবাদিকতার উৎসাহ আরও বেড়ে যায়। কখন কি ঘটে সেই খবরের জন্য চোখ কান খোলা রাখতে হয় সব সময়। মোবাইল, ল্যাপটব, ডেক্সটপ, ভিডিও ক্যামেরা প্রস্তুুত থাকে সব সময়। সংসার চাকুরী, ছেলে মেয়েদের পড়ালেখা, স্বজনদের সাথে সু সম্পর্ক রেখেও সাংবাদিকতাকে পেশা হিসাবে বেছে নিয়েছেন তিনি।
তিনি বলেন, দীর্ঘদিন সাংবাদিকতা করেছি। অনেক দুযোর্গ, সমস্যা মোকাবেলা করে আজকের আফরোজা লুনা হয়েছি। বন্যা, খড়া, দুর্যোগ ও সমাজের দুর্নীতি অনিয়ম, অসঙ্গতি কে তুলে আনতে ছুটে যান গাইবান্ধার শহর দুর্গম চরাঞ্চল ও বিভিন্ন উপজেলার দুর্গম পথে পথে । বন্যায় হাটু পানি, কোমর পানিতে ডুবে থাকা বানভাসী মানুষের ভিডিও ছবি তুলতে গিয়ে একবার নৌকা থেকে পানিতে পড়ে যান। সাঁওতাল ও আদিবাসী পল্লীতে দীর্ঘদিনে আন্দোলনে রাত দিন খেয়ে না খেয়ে সাঁওতালদের সাথে পল্লীতে খবর সংগ্রহ করতে গিয়ে বিচিত্র অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়েছেন তিনি। খাবারের কোন ব্যবস্থা ছিলোনা আশে পাশে ফলে সাঁওতাল পল্লীতে দিনভর পড়ে থাকতে হতো আফরোজা লুনা সহ অন্যান্য সাংবাদিকদেরকে। আফরোজা লুনা ২০১৫ সালে গাইবান্ধা প্রেসক্লাবে প্রথম নারী সাংবাদিক হিসাবে সদস্যপদ লাভ করেন। পেশাদার সাংবাদিকতায় ১৩ বছর পেরিয়ে এখনও তিনি তার অবস্থান ও সাংবাদিকতাকে সততা ও নিষ্ঠার সাথে পালন করে যাচ্ছেন।