জ্ঞান অর্জন করেই ভাঙতে হবে জাতের বেড়ি
সুহাদা মেহজাবিন
প্রকাশ : ২৯ অক্টোবর ২০২৪, ০৮:৪৪ রাত
সংগ্রামী ও সাহসী মেয়েদের কথা বর্তমান প্রজন্মের নবীনদের কাছে পৌঁছে দেওয়ার একটি অভিনব উপায় হতে পারে রুসকিন বন্ড এর লিখা "উবাচ" নামের বইটি। এটি আসলে দু’মলাটের পঁয়ত্রিশটি পোস্টারের একটি সঙ্কলন। সমাজের পরিচিত ছাঁচ ভেঙে মুক্তি খুঁজেছিলেন যে মেয়েরা, তাদের কয়েক জনের ছবির সঙ্গে তাদেরই কথা থেকে উদ্ধৃতি নিয়ে তৈরি বাংলায় পোস্টারগুলি। বইটিতে তার সঙ্গে সংযোজন হয়েছে উদ্ধৃতির ইংরেজি অনুবাদ, আর সেই সঙ্গে বাংলা ও ইংরেজিতে প্রত্যেকের সংক্ষিপ্ত জীবনী। এক-এক জন মেয়ের কথা পাশাপাশি দু’টি পাতায় রয়েছে। পোস্টারের ধর্মই হল ছবি এবং অল্প কথায় একটা গল্প বলা, যা আরও জানার আগ্রহকে উস্কে দেয়। এই বইয়ের পোস্টারগুলি সেই কাজ করেছে অতি চমৎকার ভাবে। স্কুলশিক্ষিকা সাবিত্রীবাই স্কুলে যাওয়ার সময়ে একটা বাড়তি শাড়ি নিয়ে যেতেন। রাস্তায় এত লোক কাদা ছুড়ত যে স্কুলে পৌঁছে কাপড় বদলাতে হত তাকে। পোস্টারটি দেখার পর পাঠকের কি ইচ্ছা করবে না তার সম্বন্ধে আরও একটু জানতে?
সাবিত্রী রাইয়ের সেই অভিজ্ঞতা প্রতিধ্বনিত হয়েছে আরও কত মেয়ের জীবনে। বাংলার প্রথম ম্যাট্রিক পাশ-করা মেয়েদের মধ্যে এক জন ছিলেন সরলা রায়। পরে তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম মহিলা সদস্য হয়েছিলেন। সেনেট হলের সিঁড়ি দিয়ে প্রথম বার যখন ওঠেন সরলা তখন ছেলেরা চার দিক থেকে তাকে "দুয়ো" দিত। অনেকে মেঝেতে থুতু ফেলে বিরক্তি প্রকাশ করে। ১৯২০-র দশকে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম মুসলিম ছাত্রী ফজিলতুন্নেসা জোহা বোরখা ছেড়ে যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে যেতেন লোকে ইট-পাটকেল ছুড়ত তাকেও।
এই মেয়েরাও কি ‘স্বাধীনতা সংগ্রামী’ ছিলেন না? মানুষের মতো, নিজের মতো করে বাঁচার স্বাধীনতা আদায়ের লড়াই নানা ভাবে, নানা দিকে লড়তে হয় তাদের। প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার বা বীণা দাসের মতো মেয়েরা স্বাধীনতার জন্য হাতে অস্ত্র তুলেছিলেন। রেণুকা রায়, চন্দ্রপ্রভা শইকীয়ানীর মতো মেয়েরা মহাত্মা গান্ধীকে অনুসরণ করে সত্যাগ্রহে যোগ দিয়েছিলেন। মণিকুন্তলা সেন, বিমলা মাজী সামাজিক ন্যায় ও সাম্যের আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে জন-আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছেন। এদের সহজেই ‘নেত্রী’ বলে চিনে নেওয়া যায়। কম আলোচিত কেতকী দত্ত, রেবা মুহুরী বা আরতি সাহা, যাঁরা মঞ্চে, শিল্পে, খেলা-ধুলোয় আর সব মেয়েদের প্রবেশপথ তৈরি করে দিয়েছিলেন।
একটা চার পাতার নিবন্ধের চেয়ে একটা ভাল পোস্টার অনেক বেশি মনে গেঁথে যায়। যেমন ইসমত চুঘতাইয়ের বুদ্ধিদীপ্ত মুখের পাশে এই কথাগুলি: “রোজ প্রার্থনা করতাম, ও আল্লা, আমাকে ছেলে করে দাও, যাতে ঘুড়ি ওড়ানোর জন্য আমাকে মার না খেতে হয়, যাতে আমি প্রাণভরে কাবাডি খেলতে পারি, আর নির্ভয়ে বাঁদরের পিছনে দৌড়তে পারি।” ঝকঝকে ছাপা আর কুশলী পুস্তক নির্মাণের গুণে বইটি সুদৃশ্যও বটে।